“রাজনীতি” শব্দটার সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে অনেকগুলো শব্দের মৌলিক অর্থকে একীভূত করে বাস্তবতায় রূপায়ণ করা প্রয়োজন। আদর্শ,ত্যাগ,সততা,আনুগত্য ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার বস্তুনিষ্ঠ নির্যাস দিয়েই রাজনীতি শব্দের সৃজন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সেবার ব্রত নিয়ে “রাজনীতি” নামক বহুমাত্রিক কল্যাণকর শব্দটিকে রাজনীতিবিদদের অন্তরে লালন করার উচিৎ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতি সহজলভ্য ও বিনিয়োগহীন হওয়ায় বেচে থাকার অবলম্বন হিসেবে অনেকেই এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে বিধায় দেশ ও দেশের মানুষ সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের সেবা ও সান্নিধ্যে থেকে বঞ্চিত। মূলধন ব্যাতিত অল্প সময়ে আলাদিনের চেরাগে নিজ জীবনমান সার্বিকভাবে আলোকিত করার প্রয়াসে স্বীয় স্বার্থের প্রবৃদ্ধির নামই এখন রাজনীতি।

আদর্শিক রাজনীতিতে দায়বদ্ধতা নিয়ে যাদের আগমন ঘটার কথা, তারা অনেকেই বিগত ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক চিত্র বিবেচনায় অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে ও আত্নসম্মান বাচাতে রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে অথবা নীরব রয়েছে। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পর্যন্ত যারা নিজ পকেটের অর্থ খরচ করে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থেকে দেশমাতৃকার সেবা ও উন্নয়নে সরব ছিলো, রাজনীতিতে তাদের বর্তমান অংশগ্রহণ হাতেগোনা হিসেবেই দৃশ্যমাণ, যা বংশপরম্পরার ছকেই অনেকটা আবদ্ধ।

তৃনমূল পর্যায়ে সক্রিয় রাজনীতিতে সরব থেকে দলের অন্তিম ও সংকটকালে যারা জীবন বাজী রেখেছে, জনগণের দুঃখ দূর্দশায় পাশে দাড়িয়েছে, তারা বর্তমান অপরাজনীতির শিকার হয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মূল্যায়িত হয়নি। রাজনীতিতে অক্ষরজ্ঞানহীন আর্থিক সক্ষমতা সম্পন্ন অনেক ব্যবসায়ীরাই এখন রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের স্বত্তাধিকারী। ব্যবসায়ীক প্রসার ও নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিতে এদের পদার্পণ। দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের স্টিয়ারিং এখন কথিত রাজনীতিবিদদের হাতে। অবস্থার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিকভাবে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কেউকেউ পেটের দায়ে এখন ওদের তরিকার মুরিদ, কেউবা মূল্যায়নের অভাবে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ভিন্ন মতাদর্শের কথিত রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশ ও পদপদবী বাগিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতি আজ ত্যাগী ও আদর্শিক রাজনীতিবিদদের গর্তে লুকিয়ে রেখেছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কিছু আদর্শ রয়েছে। দুচারটি আদর্শ বাদে মৌলিক আদর্শগুলো কিন্তু এক ও অভিন্ন, যা দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিবিদ যখন অন্যকোন রাজনৈতিক দলের মূল চালিকাশক্তির একটা অংশ হয়, তখন সংশ্লিষ্ট দলের প্রকৃত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন হয় এবং অন্যদলের ভিন্ন মতাদর্শের নেতাকর্মী ক্রমান্বয়ে অনুপ্রবেশের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এভাবেই প্রতিটি রাজনৈতিক দল আদর্শহীনতার শিকার হয়ে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে, যা মুহুর্তেই অনুমেয় নয়।
দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে যদি সত্যিকারে রাজনীতি করতে হয়, তাহলে বিগত ত্রিশ বছর একই ছাতার নীচে আদর্শিক ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে প্রযোজ্যক্ষেত্রে পদায়ন করার দিকে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে স্থির থাকতে হবে। হঠাৎ মানুষের পাশে দাড়িয়ে কোটি টাকার ত্রান বিতরণ ও প্রচার নির্ভর মমতায় দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অল্প সময়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে দেওয়ার এই সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিৎ। ত্রিশ বছর সার্বিক ত্যাগের বিনিময়ে যারা রাজনৈতিক ভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে, তারা দলের জন্য হয়তো থ্রেট হবেনা কিন্তু তৃনমূলের কর্মীরা আস্থার সংকটে পড়ে রাজনৈতিক ভ্যানগার্ডের অভাবে একটা সময় হয়তো নীরব হয়ে যাবে অথবা ভিন্নমতাবলম্বীদের আর্কোষের শিকার হয়ে দলের প্রতি আনুগত্য হারাবে।

দলীয় প্রধানদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, আদর্শের বিচ্যুতি, মনোলোভা কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রথাগত দুর্বলতা, আত্নীয়করণ, অনির্ভরযোগ্য সোর্সের প্রতি অটুট আস্থাবোধ, ও তেলিবাজির অপসংস্কৃতির আধিক্যের কারণেই রাজনৈতিক অসারত্বের সৃষ্টি হয়েছে।সম আদর্শের কেউ রাজনৈতিক ভাবে মূল্যায়িত হলে রাজনৈতিক দলে উল্লেখযোগ্য খারাপ প্রভাব পড়েনা, কিন্তু প্রতিটি দলের গ্রুপিং এর সৃষ্টি তখনি হয়, যখন রাজনীতিতে অখ্যাত ও ভিন্নমতাবলম্বী কেউ রাজনৈতিক স্টিয়ারিং হাতে পেয়ে রাজনৈতিক পোষ্টমর্টেম করতে লিপ্ত হয়।
দল গোছানোর কাজটা রাজনীতিতে শিডিউল ওয়ার্ক হসেবেই মূখ্য ভূমিকায় নেওয়া উচিত। দলের বিচলিত অবস্থা রেখে যেমন রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা পাওয়ার আশা করা যায়না, ঠিক তেমনি ক্ষমতাসীন থেকেও দলীয় কর্মীদের প্রতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের কাঙ্খিত ভাগ্য উন্নয়ন করতে না পারলে পরবর্তীতে মসনদ ধরে রাখাটা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। বিবেকের দায়বদ্ধতা নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন নিয়ে কাজ করলে জনগণই ক্ষমতা অলংকৃত করার উদ্যোগ নিবে। রাজনৈতিকভাবে সমন্বয়হীনতা, অবমূল্যায়ন, স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি ও আদর্শহীনতা রাজনীতিতে অসারত্বের জন্ম দেয়, জন্মদেয় রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি। দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন ও রাজনৈতিক আদর্শই হোক প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূলনীতি।

মোস্তাফিজুর রহমান।
গোপালগঞ্জ।
তারিখঃ ২৪/০৯/২০২০ ইং।