শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের পরবর্তী আমির কে হবেন তা নিয়ে চলছে আলোচনা। পরিবর্তন এসেছে কওমি মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং উচ্চতর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’এর চেয়ারম্যান পদেও।

আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের আমির পদে দুই বাবুনগরীর নাম রয়েছে আলোচনায়। তারা হলেন- হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। ঢাকার চারিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীকেও হেফাজতে ইসলামের আমির করার দাবি তুলেছে হেফাজতের একটি অংশ।

এদিকে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে আনাস মাদানী ও আল্লামা আহমদ শফীর অব্যাহতিসহ ৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামা ছাত্ররাই এখন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির পদে জুনায়েদ বাবুনগরী ও মহাসচিব পদে মামুনুল হককে দেখতে চান।

এমন দাবি করে তারা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার গেটে ব্যানার টাঙিয়েছেন। মাদ্রাসার ফেসবুক পেজেও ওই ব্যানার সম্বলিত স্ট্যাটাস সাঁটিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন মোহাম্মদ রুবেল নামে মাদ্রাসার এক ছাত্র।

স্ট্যাটাসে ব্যানারের ওপরে তিনি লিখেন, চট্টগ্রামে হাটহাজারী মাদ্রাসার তথা হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া সরকার! সরকারের অনুগত আলেম, বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসন নানা কুটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। আলেম ওলামা ও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। জানা গেছে, হেফাজতের আমীর কে হবেন মৃত্যুর আগে সেটা ঠিক করে গেছেন শাহ আহমদ শফী। তার নির্ধারণ করে যাওয়া নতুন কমিটিতে শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরী স্বপদে বহাল থাকলেও সিনিয়র নায়েবে আমির করেছেন হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আহমেদ দিদার কাসেমীকে।

মৃত্যু ও অন্যান্য কারণে কমিটি থেকে বাদ পড়েন অন্তত ৩০ জন। কমিটিতে যুক্ত করা হয় নতুন প্রায় ১৫০ জনকে। কমিটিতে নায়েবে আমীর করা হয়েছে ৪২ জনকে। যুগ্ম মহাসচিব ও সহকারী যুগ্ম-মহাসচিব করা হয়েছে ১৫ জনকে।

এছাড়া সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৮ জন, অর্থ সম্পাদক ও সহকারী অর্থ-সম্পাদক ৮ জন, প্রচার ও সহকারী প্রচার সম্পাদক ১২ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ১৩ জন, সমাজ কল্যাণ ও সহ-সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ১২ জন, শিক্ষা প্রশিক্ষণ সম্পাদক ৬ জন, আইন বিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ৬জন, শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ৬ জন, তথ্য গবেষণা সম্পাদক ৭ জন, দপ্তর সম্পাদক ও সহ-দপ্তর সম্পাদক ৮ জন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক ৮ জন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ৮ জন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক ৭ জন এবং কার্যকরী সদস্য করা হয়েছে ২৯ জনকে।

২১১ সদস্য বিশিষ্ট এই নতুন কমিটি ১৩ আগস্ট অনুমোদন করেন আহমদ শফী। এর আগে গত ৮ জুলাই আল্লামা শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরী এক বিবৃতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ঘোষণা দেন। কিন্তু শফীর জানাজা ও দাফনের দিন বাদ আসর জরুরি বৈঠকে দ্রুত হেফাজতের সম্মেলন করার ঘোষণা দেন জুনায়েদ বাবুনগরী।

এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি দু’পক্ষ তৈরি হয়। একটি হচ্ছে জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী। অন্যটি শফীপূত্র আনাস মাদানীর অনুসারী। মাদানীর অনুসারীদের দাবি, শফী নতুন কমিটির অনুমোদন দিয়ে গেছেন। এই কমিটিই বাস্তবায়ন হবে।

অন্যদিকে বাবুনগরীর অনুসারীরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, এক মাসের মধ্যে কাউন্সিল ডেকে হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন করা হবে। মাদ্রাসার আন্দোলনকারী ছাত্ররাও এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিচ্ছে। এরমধ্যে হেফাজতের আমির পদে বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও মহাসচিব পদে আল্লামা মামুনুল হককে দেখতে চান- এমন স্ট্যাটাস সাঁটিয়েছেন মাদ্রাসার ফেসবুক পেজে।

অপর একটি স্ট্যাটাসে আনাস মাদানীসহ শফীর অনুসারী ১৮ আলেমকে মাদ্রাসায় প্রবেশে স্থায়ীভাবে নিষেধের বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা।

বিভিন্ন কারণে হেফাজতের প্রয়াত আমির শফী ও মহাসচিব বাবুনগরীর মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে গত ১৬ সেপ্টেম্বর জোহরের নামাজের পর মাদ্রাসায় ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। ওইদিন বিক্ষোভের মুখে শুরা মজলিসের জরুরি সভায় আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার আহমদ শফী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ ছাড়েন। ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মারা যান তিনি।

আনাস মাদানীর অনুসারীদের দাবি, হেফাজতের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা চিহ্নিত একটি গোষ্ঠী কূট কৌশলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তার বহিষ্কার অবৈধ। আল্লামা শফীকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি তার অক্সিজেন মাস্ক খুলে রেখে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাদের ভাষ্য, তথাকথিত কাউন্সিল ডেকে মরহুম আহমদ শফীকে হেনস্তাকারীদের নেতৃত্বে আনার চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী এক ভিডিওবার্তায় বলেন, সদ্য প্রয়াত দেশের প্রখ্যাত আলেম, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। তার মৃত্যু অস্বাভাবিকভাবে হয়নি।

তিনি বলেন, হযরত আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। যখন বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন, তখন তাকে মজলিশে শুরার সদস্যরা হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি কিছুটা সুস্থ হলেও শ্বাসকষ্ট ছিলো। তাই পরে তাকে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তিনি আরো বলেন, ১৮ তারিখ শুক্রবার হযরত ইন্তেকাল করেন। এই ইন্তেকালটি স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক হয় নাই। হযরতকে কেউ খুন করে নাই, খুন করার কোন প্রশ্নই নাই। যেখানে সকলের চোখের অশ্রু ঝরেছে, সবাই হযরতে আশেক। খুন কে করবে? হযরতের দুশমন এখানে কেউ নাই, সব দোস্ত, বন্ধু, আশেক, ছাত্র, মুরিদান, খুলাফা। সুতরাং হযরতের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। এটা হাকিকত, এটা বাস্তব। এর বিপরীত যদি কেউ বলে, হযরতের লাশ নিয়ে যদি কেউ রাজনীতি করে; হযরতের মৃত্যু অস্বাভাবিকভাবে হয়েছে, তাকে খুন করা হয়েছে, এসব কথা যারা বলে, এগুলো নির্ভেজাল মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। আপনারা এগুলোর দিকে কান দেবেন না। এগুলোর দ্বারা মাদ্রাসার আরো ক্ষতি হবে। পরিবেশ অশান্ত হয়ে যাবে।

জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, কেউ কেউ বলছে এটা সরকারিভাবে তদন্ত করা হোক। এটা যদি করা হয় তবে হযরতের লাশ কবর থেকে তোলা হবে। এটা করলে হযরতের সঙ্গে চরম বেয়াদবি করা হবে, চরম বেয়াজ্জতী হবে। এসব মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে মাদ্রাসাকে ধ্বংস করার জন্য। আমরা জান দিয়ে হলেও এই মাদ্র্রসাকে হেফাজত করবো ইনশা আল্লাহ।

সূত্র মতে, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশপরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে আহমদ শফীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নিজেকে সংগঠন থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায়ও আর আসেননি। তবে সম্প্রতি তিনি মজলিসে শূরার বৈঠকে উপস্থিত হন।

মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের আগে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। শাপলা চত্বরের জমায়েতপরবর্তী সময়ে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সমঝোতারও বিরোধিতা করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে কওমি ঘরানার বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম গড়ে তোলেন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী। কওমি ঘরানার সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলকে এক ব্যানারে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। ১৩ দফা দাবি দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে আলোচনায় আসেন আহমদ শফী।

এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলে খবরের শিরোনাম হন। পরবর্তী সময়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কওমি সনদের স্বীকৃতি আদায় করেন তিনি। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বিভিন্ন অভিযোগে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে।

আন্দোলনের সময় মাদরাসায় অবস্থান করা আহমদ শফী অসুস্থ হয়ে পড়লে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে থাকাবস্থায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হলে সন্ধ্যার দিকে ১০৫ বছর বয়সে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।