ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। ইদানীং এর মাত্রা উচ্চহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবুও এটা সার্বিক পরিস্থিতির পরিপূর্ণ চিত্র নয় । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে, কেবল সেগুলো নিয়েই আমরা সরব হচ্ছি। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক অনাচার ও ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায় মোড়লদের রক্তচক্ষুর বেপরোয়া ও একপেশে বিচার ব্যবস্থায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই আইন মনে করে নিরীহ ও অসচেতন মানুষগুলো। ভিকটিম বিচারের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে পূনরায় নিরাপদে বাচার আশায় ক্ষত ধারণ করে নীরবেই কাটিয়ে দেয় ইম্যাচুর ও ইলিজিটিমেট প্রেগন্যান্সির দায় নিয়ে। ঘৃনিত এই চিত্রের দায় কার? আমার শিশুকন্যাও এদের পৈচাশিক মনোবৃত্তির বাইরে নয়। একটি ধর্ষণ শুধু ইলিজিটিমেট একটা এপিসোড নয়, এটার ইমপ্যাক্ট পুরো পরিবারকে ক্ষতচিহ্ন সৃজন করে দেয়, যা বিচারের অয়েন্টমেন্টে কোনদিনই মুছে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেনা। কেন এমন হচ্ছে? এটাও ভাবা দরকার। যারা ধর্ষণের সাথে জড়িত,তারাও আমাদের কারো সন্তান। তাহলে আমার সন্তানের এমন পৈচাশিক মনোবৃত্তি কেন ? একবারও ভেবেছেন কি?

পরিবারই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার সূতিকাগার। আতুরাশ্রম খ্যাত এই আলয় থেকেই নৈতিকতার চারাগাছ জন্ম নেয়, আর একাডেমিক শিক্ষা ও দৈহিক প্রসারতার সাথেসাথে এটার ডালপালা বিস্তার লাভ করে মনুষ্যত্বর প্রলেপে একজন মানুষকে মানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেয়। শৈশব, কৈশোরের দুরন্তপনার মধ্যেও যারা পারিবারিক সুশিক্ষায় প্রতিটি দিন পার করে, তারা জীবনের সার্বিক সফলতা না পেলেও নৈতিকতা বিবর্জিত কোন কর্মকাণ্ডের সাথে নিজকে জড়ানোর মনোবৃত্তি ধারণ করেনা।

প্রতিটি মানুষ যখন পারিবারিক সুশিক্ষার বেড়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে ম্যাচুরিটি লাভ করে, তার আচরণের বহিঃপ্রকাশও সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে নৈতিক প্রভাব বিস্তার করে । পারিবারিক দায়বদ্ধতা, সুশিক্ষার অভাববোধই আজ সামাজিক অনাচারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে। পরিবার থেকে নৈতিকতাবোধ আকড়ে ধরে বেড়ে উঠা মানুষের অপ্রতুলতার কারণেই আজ সমাজ ব্যবস্থা দুর্বল। দুর্বল সামাজিক অবকাঠামোর কারণেই সামাজিক আন্দোলনের কচ্ছপ গতি। গা বাচানো সংস্কৃতির কথিত নৈতিকতায় সামাজিক আন্দোলন বেগবান হয়না বিধায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে অপরাধ করে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় এবং নতুন নতুন ঘৃনিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়াতে অনুপ্রেরণা লাভ করে।

অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামাজিক সোচ্চারের অভাববোধ রাষ্ট্রযন্ত্রকে মাঝেমধ্যে নিস্ক্রিয় করে রাখে। অপরাধ প্রবণতার যে সকল বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন কিছু মানুষ যখন এটার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখনই রাষ্ট্রযন্ত্র নড়েচড়ে বসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে । সামাজিক অনাচারের এই দায় রাষ্ট্রযন্ত্রের নয়,এ দায় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা ব্যবস্থার।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে দোষারোপ করতে গেলে নিজ বিবেকের দায়বদ্ধতাকে আগে ঝাড়ুপিটা করে নেওয়া দরকার। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের দর্পন ও ম্যাসেঞ্জার হলো দেশের জনগণ, যারা অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত । কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতি আমরা কি রোল প্লে করছি? নিজ বিবেকের নিকট প্রশ্ন রাখুন, লজ্জা না পেলেও নিজকে বেহায়া ভাবুন, কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হবে।

জনগণ যদি জাগরিত না হয় তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রও অপরাধ প্রবণতার প্রযোজ্য ফিসিবিলিটি স্ট্যাডি থেকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে সুবিচার আশা করলে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনগণ হিসেবেই সকলকে বিবেকের দায়মুক্তির জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে, ভিকটিমের পাশে দাড়াতে হবে । গা বাচানোর প্রত্যয়ে নিজ দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা যখন ভাগাড়ে নিক্ষেপ হয়, তখন সংঘটিত অপরাধ কর্মকান্ডের সুবিচার আশা করাও গোবরগণেশের বহিঃপ্রকাশ ব্যাতিত অন্য কিছু নয়।
একটি কথা মনে রাখা দরকার ঃ এদেশের মাটি, আলো বাতাস আর প্রকৃতির অনুদান নিয়ে সকলের বেড়ে উঠা। বাড়ন্ত শরীরকে মনুষ্যত্ব্যর পুষ্টি সরবরাহ করার জন্য নানান ইন্সটিটিউশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র তার তহবিল থেকে সকলের জন্য যে ভর্তুকি দিয়ে আসছে, তার দায় কি আমরা পরিশোধ করতে পেরেছি? খুব কম লোকই পেরেছে দেশ মাতৃকার এই দায় পরিশোধ করতে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায় পরিশোধ করতে হলে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বা স্বপ্রণোদিত হয়ে কল্যাণকর কর্মকান্ডে সকলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দৃশ্যমাণ হওয়া প্রয়োজন, তাতে করে কিছুটা হলেও বিবেকের দায়মুক্তি হবে।

★ আপনার আমার জন্যে ঃ
সচেতন অভিভাবক হিসেবে আপনি পারিবারিক সুশিক্ষা নিশ্চিতকল্পে শৈশব থেকেই আপনার সন্তানকে বিবেকের দায়বদ্ধতার কাউন্সেলিং করিয়ে নিন, ম্যাচুরিটি লাভ করলে নজরদারিতে রাখুন। পাশাপাশি অনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সামাজিকভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য অপরকেও উদ্দুদ্ধ করুন। এটা আপনার কর্তব্য।

★ রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্যে ঃ
সকল অনাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দেশের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও নৈতিক শিক্ষামূলক কার্যক্রম গণমূখী করার প্রত্যয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন উপায়ে মাসপাবলিকেশনের মাত্রা অক্সপান্ড করা এবং ধর্ষণ নামক ঘৃনিত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে স্বল্প সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে , যে শাস্তি হতে পারে খুব নির্মম ও প্রকাশ্য শিক্ষা। শুধুমাত্র ধর্ষণের ক্ষেত্রে মানবতা ও বিচারবহির্ভূত শব্দ দুটি বিচারিক বিধি থেকে এলিমিনেট করে প্রতিটি নারীকে স্বাচ্ছ্যন্দে,নির্ভয়ে ও নিরাপদে পথচলার সুযোগ করে দেওয়াই উত্তম।

আমি কন্যা সন্তানের বাবা। আমি নির্ঘুম রাত কাটাই আমার সন্তানের নিরাপত্তার প্রশ্নে! এমন নিস্পাপ হাসিতে প্রফুল্লচিত্তে দেখতে চাই আমার কন্যা সন্তানকে।

মোস্তাফিজুর রহমান।
গোপালগঞ্জ।
তারিখঃ ২৯/০৯/২০২০ ইং।