ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তক এর মাধ্যমে পরিচিত হওয়া ছোট্ট একটি শব্দ হলো ধর্ষণ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যে, ধর্ষণ মহামারী আকারে রূপ নিবে তা কখনো বাংলাদেশের শান্তি প্রিয় জনগণ কল্পনা করতে পারিনি । সামাজিক ব্যধিতে রুপ নেওয়া এই ধর্ষণ উঠে এসেছে পাশ্চাত্য দেশসমূহের অসভ্য এক নোংরা সংস্কৃতি থেকে । যা বাংলাদেশ একটি সামাজিক ব্যাধিতে রুপান্তর হয়েছে । দর্শন হলো এক ধরনের যৌন আক্রমণ ‌। একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরণের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয় ।

বাংলাদেশ সংবিধানে ধর্ষণের সংজ্ঞা- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন ও প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি সহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে । সংবিধানের যে ধারায় ধর্ষণ নিয়ে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারায় ধর্ষণ এবং ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির সাজা সম্পর্কে আলচনা করা হয়েছে। অত্র ধারায় একজন অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারা মতে সাজাসমুহঃ

(১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তা হলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তা হলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূন্য এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তা হলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন

সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনার পরিসংখ্যান-
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট -২০২০ (গত ৮ মাস)

নারী ধর্ষণ- ৮৮৯ জন
শুধু ধর্ষণ- ৬৯২ জন
গণধর্ষণ- ১৯২ জন
ধর্ষণের পর হত্যা- ৪১ জন
ধর্ষণের পর আত্মহত্যা- ৯ জন
ধর্ষনের চেষ্টা হয়েছে- ১৯২ জন

বাংলাদেশের একের পর এক ধর্ষণ কাণ্ড সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু জনগণ প্রত্যাশিত দৃষ্টান্তমূলক বিচার একটিরও করা সম্ভব হয়নি । কারণ,অধিকাংশ হলো ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী । বিভিন্ন রকমের ভয়-ভীতি দেখিয়েমামলা করা থেকে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে বিরত রাখে । উপরন্ত কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। যা কখনো সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশে আজ কেউ কোথাও নিরাপদ না। মা তার মেয়েটিকে বাইরে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে থাকতে পারে না। প্রতিটি মুহূর্ত তার পেরেশানির মধ্যে দিয়ে যায়। সবসময় চিন্তিত থাকে দিন শেষে তার মেয়েটি ঘরে নিরাপদে ফিরবে তো? না, সমাজে পরিচয় দিতে হবে একজন ধর্ষিতার মা হিসেবে ।

বাংলাদেশের ধর্ষণের হার বাড়ার অন্যতম কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের প্রতিবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা প্রক্রিয়ার তদন্ত, ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট, আইনজীবীদের অনাগ্রহ এবং পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে চূড়ান্ত রায়ে মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আইনগতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত চার্জ দেওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের কর্মভার ও পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে অথবা প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকায় মামলার চার্জশিট দেওয়া হয় না। এই কারণে ভুক্তভোগী নারী ও শিশু ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয় ।

বর্তমানে ধর্ষণের ঘটনা গুলো দেখে মনে হচ্ছে যে, আমাদের আর আইয়্যামে জাহেলিয়া সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নেই। কেননা আমরা আইয়্যামে জাহেলিয়া তেই অবস্থান করছি । ধর্ষণকারীরা এতটাই পাশবিক যে, ছোট্ট বোন সমতুল্য সাড়ে তিন বছরের শিশু তানহা কেউ তারা ছাড় দেয়নি । সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটলো তা অত্যন্ত লোমহর্ষক । নরপশুরা একজন মা সমতুল্য নারীর সাথে এরকম করলো অথচ তাদের বিবেকে কি একবারও নাড়া দিলো না? স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসে যদি বাংলাদেশের অবস্থা এইরকম হয় তাহলে দেশটি স্বাধীন করে কি লাভ হল?

বর্তমানে প্রিয় এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে পরিচিত হয়েছে বিবস্ত্র বাংলাদেশ হিসেবে। এই অবস্থা হতে উত্তরণের পথ হিসেবে সরকারকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । সাথে সাথে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই কাজ করার সাহস দেখাতে না পারে এবং এ রায় হতে হবে জনগণের প্রত্যাশিত রায়। তাহলেই আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি জনগণের প্রত্যাশিত ধর্ষণমুক্ত একটি সুন্দর মাতৃ ভূমিতে পরিণত হবে।

মো. আনসারুজ্জামান সিয়াম
শিক্ষার্থী, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ