আর্থিক অনাটন ও ঋণের টাকা পরিশোধে একদিনের সন্তানকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হাসিনা বেগম (৩৫) অবশেষে সন্তান ফেরত পেলেন। এছাড়াও সরকারি ভাবে তিনি পাচ্ছেন ঘর ও ভাতা।

শুক্রবার (০৯ অক্টোবর) রাতে বিক্রি হওয়া সেই নবজাতককে ফেরত এনে প্রতিবন্ধী হাসিনার হাতে তুলে দেন আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।

হাসিনা বেগম আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টেপারহাট গ্রামের জোকতার আলীর স্ত্রী। তিনি একই এলাকার তালুক হরিদাস নয়াটারী গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের মেয়ে। জানা গেছে, ১৮ থেকে ২০ বছর আগে একই গ্রামের টেপারহাট গ্রামের জোকতার আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় হাসিনার। কিন্তু হাসিনা ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের কিছুদিন স্বামীর বাড়িতে থাকলেও পরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হাসিনার ঠাঁই হয় তালুক হরিদাস নয়াটারী বাবার বাড়িতে।

সংসারের খরচ বহন না করলেও স্বামী জোকতার সম্পর্ক রেখেছিল হাসিনার সাথে। এরই মাঝে তার সংসারে এক মেয়ে ও দুই ছেলের জন্ম হয়। বড় মেয়ে রোসনার বিয়ে দেন।

ফুটো টিনের ওপর পলিথিন সাঁটানো একমাত্র ঝুপড়ি ঘরে দুই ছেলে হাসান ও রাসেলকে নিয়ে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হাসিনা বেগম। করোনার জন্য কাজ না থাকায় বেকার হাসিনার ১০ হাজার টাকা দেনা হয়ে যায়। এরই মাঝে গত ৬ অক্টোবর সকালে এক ছেলে সন্তান প্রসব করেন হাসিনা।
অভাবের মাঝে সন্তানকে কিভাবে লালন-পালন করবেন এ নিয়ে চিন্তায় পড়েন হাসিনা। তবে তার ভাই নিঃসন্তান কেরামত আলী বোনের সন্তানকে নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রতিবেশী অধির চন্দ্র তার শ্বশুরবাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট এলাকার জনৈক দম্পতিকে সন্তানটি দিতে বলেন। এতে বাঁধা দেন হাসিনা ও তার বড় ছেলে হাসান।

অধির চন্দ্র রাজারহাটের ওই দম্পতির হাতে নবজাতককে তুলে দিতে হাসিনা ও তার ছেলে রাজি না হলেও জোকতার ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে জোরপুর্বক সন্তানকে তুলে দেন ওই দম্পতির হাতে। নবজাতক বিক্রির টাকায় ঋণের ১০ হাজার পরিশোধ করেন হাসিনা বেগম। কিন্তু নাড়ি ছেড়া ধন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছোট ভাইকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে বড় ভাই হাসান বাবা মায়ের সাথে অভিমান করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
এ নিয়ে শুক্রবার দুপুরে দেশের সেরা অনলাইন নিউজ পোর্টালে, ঋণের টাকা পরিশোধে একদিনের সন্তানকে বিক্রি!’ এমন শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি দেখে গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এডিসি আহসান খানসহ জেলা প্রশাসক আবু জাফরের নির্দেশে একইদিন দুপুরে ওই বাড়িতে যান আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম। এসময় বিক্রিত নবজাতককে ফেরত নিয়ে আসতে দাতাকে ফোনে জানানো হলে রাতে নবজাতককে ফেরত নিয়ে আসেন গ্রহনকারীরা। এরপর রাতে পুনরায় হাসিনার বাড়িতে যান ইউএনও এবং ওসি। তারা সেই নবজাতককে হাসিনার বেগমের হাতে তুলেন দেন।

এ সময় নবজাতকের জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা হাসিনাকে প্রদান করা হয়। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় হাসিনাকে প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকাভুক্তসহ জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী হাসিনা ও তার ভাই কেরামত আলীকে পৃথক দুইটি ঘর দেওয়ার ঘোষণা দেন ইউএনও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হাসিনা বেগম বলেন, “ছাওয়া (নবজাতক) ফেরতসহ নগদ টাকা পাইলাম এবং ভাতা ও ঘর দিবার চাইছে। যারা এসব দিলো আল্লায় তাদের ভালো করবে।”

মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রশাসনকে সহায়তা করায় ধন্যবাদ জানিয়ে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর। নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরো কোন প্রয়োজন হলে সরকারি ভাবে সহায়তা করা হবে বলেও জানান তিনি।