গণপিটুনিতে নয়, ছিনতাইয়ের অভিযোগে ধরে নিয়ে টাকার দাবিতে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান উদ্দিনকে। রাত সাড়ে তিনটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত দফায় দফায় নির্যাতনে টেনে তোলা হয় তার হাতের আঙুলের নখ, বেদম প্রহারে ভেঙে ফেলা হয় হাত-পা। নির্যাতনে বিরতি দিয়ে কনস্টেবলের মোবাইল থেকে রায়হানের পরিবারে কল করে টাকা নিয়ে এসে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়। পরিবার থেকে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে গেলেও রায়হানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রোববার ভোর ছয়টায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। কিছুক্ষণ পর সেখানে মারা যান তিনি।

পুরো ঘটনায় নেতৃত্ব দেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া। তার সঙ্গে ছিলেন কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া, টিটু চন্দ্র দাস, এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।

শনিবার রাতের এই ঘটনায় তোলপাড় চলে সিলেটজুড়ে। নিহতের স্ত্রী পুলিশি নির্যাতনে স্বামীর মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আর স্থানীয়দের বক্তব্যে পুলিশের মিথ্যাচার ধরা পড়ায় তদন্তে নামে মহানগর পুলিশের বিশেষ তদন্ত দল। ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততা ও দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়ে সোমবার বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং প্রত্যাহার করা হয় এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে। মঙ্গলবার মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) । কিন্তু মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি কাউকে।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশের সময়ক্ষেপণের সুযোগে পালিয়ে গেছেন এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া। তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার জানান, মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। নির্যাতন বা হত্যায় সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্ত চলছে। অপরাধ যেই করে থাকুক না কেন তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।

আলোচনায় এসআই আকবর

সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার অধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। অভিযোগ আছে, সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারের এই ফাঁড়িটি ক্বীনব্রিজ এলাকা ও হরিজন সম্প্রদায়ের আবাসস্থল কাষ্ঠঘরকে কেন্দ্র করে চালায় একটি বড় মাদক সিন্ডিকেট। তাই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হলেও এসআই আকবর হোসেন ভূইয়ার চালচলন ছিল ওসিরও ওপরে। পুলিশের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুদর্শন এসআই আকবরকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার নাটকেও অভিনয় করতে দেখা যায়। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িকে নিজের থানা হিসেবেই চালিয়ে নিতে তিনি। প্রতিদিনই টাকার ভাগভাটোয়ারা নিয়ে সালিস বসাতেন ফাঁড়িতেই। ফাঁড়ির ভেতরে একটি কক্ষ রয়েছে তার। সেই কক্ষকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। তার হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। নিজেকে মহানগর পুলিশের এক উপ কমিশনারের খাস মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন।

তদন্ত কমিটির একটি সূত্র জানায়, সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ সেসময় দায়িত্বে থাকা ৭ পুলিশ সদস্যকে। ইনচার্জ আকবর প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তবে সিটি ক্যামেরার ফুটেজে তার মিথ্যাচার ধরা পড়লে চুপ করে যান। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা সাত পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আরেক দফা তদন্ত চলছে। এই তদন্তের পর এদের মধ্য থেকে রায়হান হত্যা মামলায় আসামি করা হতে পারে।

এদিকে সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত তদন্ত কমিটির সামনে হাজির থাকলেও এর পর এসআই আকবরকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) এলাকা না ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত রাত থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে ধরতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযান চলছে।

ক্ষোভে উত্তাল সিলেট

পুলিশ হেফাজতে ও নির্যাতনে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যুবক মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে সিলেট নগর। গত তিন দিন ধরে দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানবন্ধন ও ঘেরাও কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ঘটনাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, রায়হান উদ্দিনকে অন্যায়ভাবে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যা এখন পরিষ্কার। এই বর্বর নির্যাতন ১৯৭১ সালের পাক হানাদারদের নির্যাতনকেও হারা মানিয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় যাদেরকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদেরকে অনতিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হতে হবে।

মঙ্গলবার দিনভর নগরীর আখালিয়া, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে বিভিন্ন সংগঠন। সাধারণ জনতা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। এর আে সোমবার রাতে নিহত রায়হানের বাসায় যান সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সেখানে তারা ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জড়িতদের শাস্তির দাবি জনান।