আমাদের দেশের অধিকাংশ পুস্তক বিক্রেতা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে ‘ গ্ৰন্থাগার বা লাইব্রেরি” শব্দটির অপব্যবহার নতুন কোন বিষয় নয়। ঠিক কবে থেকে,কার মাধ্যমে পুস্তকের দোকানের নামের শেষাংশে গ্ৰন্থাগার শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে তা আজ বড়ই অদ্ভুত রহস্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও কোন বিজ্ঞব্যক্তি কিংবা প্রথিতযশা মনীষীদের গ্রন্থাগার শব্দটির উপযুক্ত ব্যবস্থার নিয়ে তেমন উচ্চ বাচ্যকরতে দেখিনি। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্ৰন্থাগার পেশাজীবীগন পুস্তক বিক্রেতাদের খামখেয়ালিপনাও বুকস্টল গুলোকে লাইব্রেরি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার উদ্ভট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা মৌখিক প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন না। অবস্থা এমন হয়েছে যে কোনটা প্রকৃত গ্ৰন্থাগার আর কোনটা বইয়ের দোকান তার পার্থক্য করাটাই দুরূহহয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পুস্তকের দোকান আর গ্রন্থাগারের লক্ষ্যও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে,এইদুয়ের মধ্যে রয়েছে সংজ্ঞাতাত্বিক বিস্তর পার্থক্য। বুক স্টোরগুলোর মুল উদ্দেশ্য মূলতঃ পাঠ্যপুস্তক কেনা বেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ গ্ৰন্থাগার কিংবা লাইব্রেরি পাঠ্য পুস্তক বিনামূল্যে পাঠকদের জন্য সংগ্ৰহ , সংরক্ষণ ও বিতরণের উদ্দেশ্য গড়ে উঠে এবং আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

সারাদেশে পুস্তক ব্যবসায়ীরা অজ্ঞতার কারণেই হোক কিংবা ইচ্ছে করেই লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ করে চলেছেন যা গুটিকয়েকব্যক্তির পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাঁরা বুক স্টোরগুলোর লাইব্রেরি নাম ধারণ করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা বন্ধ করতেবদ্ধপরিকর। জনাব মোঃমামদুদুর রহমান এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্ৰন্থাগার পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৫সালে বাংলাদেশউন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্ৰন্থাগারিক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৯ সালে তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরে সহকারীপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সেন্টারের উপ পরিচালক হিসেবে কর্মরত ও বাংলাদেশ গ্ৰন্থাগার পেশাজীবী সমিতির সদস্য। বাংলাদেশে যেকজন ব্যক্তি বুকস্টোরগুলোর নামের শেষাংশে লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ নিয়েবেশ সোচ্চার তিনি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরে’র সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সেন্টারের উপ পরিচালক জনাব মোঃআব্দুস সামাদ প্রধানও অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে তিনি রংপুর শহরের বিভিন্ন বুক ইস্টার গুলোকে লাইব্রেরি শব্দটিকে অপপ্রয়োগ না করতে বারং বার অনুরোধ জানান।

তিনি রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষন পূর্বক রংপুর শহরের ট্রেড লাইসেন্স কর্মকর্তা/ সচিব বরাবর লিগাল নোটিশ পর্যন্ত পাঠিয়েছেন যাতে করে পুস্তক ব্যবসায়ী কতৃক লাইব্রেরি শব্দটির অপপ্রয়োগ বন্ধ করা যায়। তার ভাষায় লাইব্রেরি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠকদের জন্য সকল ধরনের বই-পুস্তক , গবেষণা সামগ্ৰী, ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লাইব্রেরি ব্যবহারকরীদের সরবারহ করা হবে ,তা কোন ক্রমেই ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য নয়। যেনটা Oxford English Dictionary থেকে জানা যায়, “ Library is a building in which collection of books, newspapers, etc., and sometimes films and recorded music are kept for people to study or borrow” অর্থাৎ, লাইব্রেরিবা গ্ৰন্থাগার হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা পুস্তক, সংবাদপত্রের সমাহার, এছাড়াও চলচ্চিত্রও রেকর্ড করা সংগীত জনসাধারণের পড়া ও ধার প্রদান করার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। এখানে লাইব্রেরির জ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে সভ্যতার বিকাশ সাধনকারীর ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে পুস্তক বিক্রেতা গন যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন।

উইকিপিডিয়া প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী “ A library is a curated collection of sources of information and similar resources, selected by experts and made available to a defined community for reference or borrowing, often in a quiet environment conductive to study”, অর্থাৎ লাইব্রেরি হলো বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞব্যক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত তথ্য ও তথ্য সদৃশ পঠন সামগ্রীর সমাহার যা সুনির্দিষ্ট ব্যবহারকরীদের নির্মল ও শিক্ষা সহায়ক পরিবেশে জ্ঞান নির্দেশনা সরূপ অথ বাধার কার্যের জন্য পঠন সামগ্রী প্রদান করে থাকে। ইউনেস্কো প্রদত্ত সংজ্ঞায় গ্ৰন্থাগার বা লাইব্রেরি হলো,”মুদ্রিত বই , সাময়িকী অথবা যে কোন চিত্র সম্ভারবা শ্রবণ, দর্শন সামগ্ৰীর একটি সংগঠিত সংগ্ৰহ। যেখানে পাঠকদের তথ্য-প্রযুক্তি,গবেষণা, শিক্ষা অথবা বিনোদন চাহিদা মেটানোর কাজে সহায়তা করাহয়।গ্ৰন্থাগার যেখানে পাঠকদের সেবার মান নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, বুক স্টোরগুলো সেখানে পুস্তক ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করতে বদ্ধ পরিকর।

জনাব মামদুদুর রহমানের আক্ষেপের জায়গাটা এখানে। একজন গ্ৰন্থাগার পেশাজীবী হিসেবে পুস্তক ব্যবসায়ীদের লাইব্রেরির নামে বই কেনাবেচার সংস্কৃতি কোনদিন ও মানতে পারেননি।তিনি ২০১৫ সাল থেকে পুস্তক ব্যবসায়ীদের বুক স্টোরগুলোতে ”লাইব্রেরি” শব্দটির অপপ্রয়োগ নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়নও সমবায় মন্ত্রণালয়ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আর,এস ও ৭নং আইন/২০১৭, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ (২০০৯ সালের ৫৮নং আইন) এর ধারা ১০০ তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার আদর্শকর তফসিলের ৬ এর উপদফা (১) এর পরিবর্তে ৪২এর (৭) ও (৮) উপটেবিলের ধারা অনুযায়ী পুস্তকবিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নাম: পুস্তক বিক্রেতা বা পুস্তক প্রকাশকের নামে নামকরণ হবে।সে অর্থেকোন পুস্তক বিক্রেতা ‘ লাইব্রেরি’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন না।

জাতির মেধা ও মননশীলতার প্রতীক হিসেবে গ্রন্থাগার সুপ্রাচীন কাল থেকেই পাদপ্রদীপের ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে গ্ৰন্থাগারের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গ্ৰন্থাগার সুশিক্ষিতও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে লাইব্রেরির নিয়েপুস্তক ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতা ও খামখেয়ালিপনার অবসানঘটানো সময়েরদাবি। জনাব মোঃ মামদুদুর রহমানের মতো কিছু আলোকিত মানুষের প্রচেষ্টা  ও আন্দোলনের মাধ্যমে একদিন নিশ্চিত ভাবেই বইয়ের দোকানের নামের শেষাংশে লাইব্রেরি শব্দটির অপব্যবহারলোপ পাবে এবং লাইব্রেরি ও লাইব্রেরি পেশাজীবীদের মানবিক মর্যাদা আরো সুসংহত হবে। লাইব্রেরিগুলো সত্যিকার অর্থেইহয়েউঠবে জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চার প্রান কেন্দ্র।

আকতারুল ইসলাম
লেখকও গবেষক