১৯৪০ দশকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান সৃষ্টির আগ থেকে সর্বপ্রথম সিলেটে নারী-পুরুষ মিলে জনসমাবেশ, বাংলা ভাষার আন্দোলনে সিলেটের তরুণ শিক্ষার্থীরা চরম ভাবে নির্যাতন বরণ,সিলেট শহরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) হলে বার বার সভা সমিতির আয়োজন, সিলেট থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীগুলো বাংলাভাষার দাবিকে জনগনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করণ, সিলেটের প্রাণকেন্দ্র গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট) উত্তাল জনসভা,মিছিলে মিছিলে উত্তাল সিলেটের রাজপথ- এই ভাবে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সিলেটবাসীরা বাংলা ভাষার দাবিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের রূপান্তরিত করার দুর্দান্ত সাহসী ও ঐতিহাসিক ভুমিকারেখেছেন। ভাষাআন্দোলনের সময় সিলেটের বাহিরে বিশেষ করে ঢাকায় সিলেটের অনেক কৃতি সন্তান উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে সিলেটের মহীয়সী নারীরা বাংলা ভাষা আন্দোলনে ব্যতিক্রমধর্মী অদমনীয় বলিষ্ট সাহসী ভুমিকা রেখেদৃষ্টান্তস্থাপনকরেছেন। ইতিহাসের পাতায় সিলেটের এই গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস স্বর্ণালীঅক্ষরেলিপিব্দ্ধ থাকবে।

জাতির বিভিন্ন সংকটময় সময়ে শাহজালালের পুণ্যভুমি সিলেটের মানুষ বার বার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
১৭৮২ সালেভারতীয় উপমহাদেশে সিলেটের পীরজাদা এবং তার দুই ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ হাদি ও সৈয়দ মুহাম্মদ মাহদী নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে উনিশ শতকে সর্বভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৪০ দশকে পাকিস্থান আন্দোলন, ১৯৫০ দশকে বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশে বিদেশে বসবাসরত সিলেটবাসীদের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে ইতিহসেলিখা থাকবে।

এখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস- বাংলা ভাষারমাস। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের মাস। তাই আজ সংক্ষিপ্ত ভাবে দুই পর্বে আলোচনা করবো বাংলা ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারী পুরুষের কি গৌরবোজ্জ্বল অবদান ছিল। প্রথম পর্বে ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীদের অবদান এবং দ্বিতীয় পর্বে সিলেটের পুরুষদের অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সিলেট ভারতের সাথে থাকবে না প্রস্তাবিত পাকিস্থানে যোগ দেবে এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়ে ছিল। উল্লেখ্য সিলেট তখন আসামের সাথে সংযুক্ত ছিল।
সিলেটে গণভোটের প্রচারণা চলাকালীন সময়ে; মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল সিলেটকে পাকিস্থানে যোগ দেয়ার পক্ষে প্রচারণার জন্য ১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে সিলেট সফর করে ছিলেন।

১৯৪৭ সালের ১১ জানুয়ারী সিলেটের একটি মহিলা প্রতিনিধি দল পাকিস্থানি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাত করে তৎকালীনপ্রধানমন্ত্রীবরাবরেতাদের কিছু দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপিহস্তান্তর করেন। এই স্মারকলিপির মধ্যে অন্যতম একটি দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা ভাষা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মারকলিপি আকারে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি উত্থাপনছিল বাংলা ভাষার দাবির ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বলতর মাইল ফলক।

১৯৪০ দশকে সারা দেশে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার অনেক আগেই সিলেটের মহিলারা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে নেমে এসে আন্দোলন শুরু করে ছিলেন। তখন থেকে সিলেটের মহিলারা ভাষার দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অনেক ত্যাগ ও নির্যাতন মোকাবেলা করেছেন। তারা সবাই মুসলিমলীগের নেতৃত্ব দানকারি পরিবারের সদস্য এবং তারা নিজেও সবাই মুসলিম লীগের নেত্রী ছিলেন, তাসত্বেওতারা মুসলিম লীগের কেনন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বাংলা ভাষার প্রশ্নে কোন প্রকার আপোস করেননি। তারা মুসলিম লীগের ভাষানীতির তীব্র বিরোধীতা ও সমালোচনা করে ভাষা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে গতিবান করে তুলেছিলেন।।

বাংলা ভাষা দাবির পক্ষে সিলেটের নারী-পুরুষের এই আন্দোলন বাধাবিঘ্ন ছাড়া বিনা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধে এগোয়নি। এ আন্দোলনের জের ধরে সে সময় সিলেটে উর্দু সমর্থক কিছু পথভ্রষ্ট লোক বাংলা ভাষার দাবির পক্ষের সভা সমিতি ও মিছিলে বাধা দেয় এবং উর্দু সমর্থক পত্রিকা ইস্টার্ণ হেরাল্ড (পরিবর্তিত নাম আসাম হেরাল্ডে) মহিলানেত্রী জোবেদা রহিমের নেতৃত্ত্বে বাংলা ভাষার দাবি করে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের বিরোধিতা করে একটি সম্পাদকীয়তে অশোভন মন্তব্য প্রকাশ করে। এই অশোভন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন মহিলানেত্রী জোবেদা রহিম সহ স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরদানকারী মহিলা নেত্রীরা। মাহমুদ আলি সম্পাদিত সাপ্তাহিক নওবেলালের ১২ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদ লিপিতে তিনি বলেন, “যাহারা পুর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করে তাহারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্রতুল্য।”

সিলেটের যে সব মহীয়সী মহিলারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন উচ্চবংসভুত সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক সচেতন পরিবারের সদস্য। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হচ্ছে- সেই সময়ে সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী জোবেদা রহীম, তিনি বাংলাদেশের মহিলাদের রাজনীতির অন্যতম পথিকৃত। তিনি ছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ শিলঘাট নিবাসী খান বাহাদুর শরাফত আলী চৌধুরীর কন্যা,হবিগঞ্জের খান বাহাদুর আবদুর রহিমের স্ত্রী এবং সেই সময়ের মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী তফজ্জুল আলীর শাশুড়ী।

বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী, (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মা), তিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। স্বামী আব্দুর রশিদ চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় বিধান সভার সদস্য। সহ-সভানেত্রী সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জননী), তিনি ছিলেন আসাম পার্লামেন্টে প্রথম মুসলমান মহিলা এমপি। সিলেটের নারীজাগরণের অগ্রদূত, ঐতিহাসিক গণভোট এবং ভাষা আন্দোলনে তার অবদান ছিলো অপরিসীম। তার স্বামী এডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন একজন বলিষ্ঠ আইনজীবি এবং মুসলিম লীগের প্রথম সাড়ির রাজনীতিবিদ।

আরো যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন, সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগের সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সিলেট সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস রাবেয়া খাতুন বিএবিটি, মিসেস জাহানারা মতিন, মিসেস রোকেয়া বেগম, মিসেস শাম্মী কাইসার রশীদ এমএ,বিটি, নূরজাহান বেগম, মিসেস সুফিয়া খাতুন, মিসেস মাহমুদা খাতুন, মিসেস শামসুন্নেছা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন (শেখঘাটের এহিয়াভিলার গৃহবধূ)।

বাংলা ভাষার দাবিতে সিলেটে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকার প্রশংসা করে ভাষা আন্দোলনে স্থপতি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনতমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কাশেম চিঠি লিখে ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকার জন্যে জোবেদা রহিম চৌধুরীসহ সিলেটের নারী নেত্রীদেরকে অভিনন্দন জানান। তিনি লেখেন, “আজ সত্যিই আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি। সিলেটের পুরুষরা যা পারেনি তা আপনারা করেছেন। বাংলা ভাষার জন্য আপনারা যে সংগ্রাম করছেন তা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।…তমদ্দুন মজলিশ আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে।“ উল্লেখ্য যে ভাষা আন্দোলনের সময় তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ছিলেন সিলেটের কৃতি সন্তান জাতীয় অধ্যাপক দেয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন সিলেটের আরেক কৃতি সন্তান অধ্যাপক শাহেদ আলী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক প্রত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন অধ্যাপক শাহেদ আলী।

১৯৪৭ সালের ৮ মার্চের গোবিন্দ চরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট) ভাষা দাবির জনসভায় উর্দুর পক্ষের লোক ও সরকারী হামলার কারণে সভা করা যায়নি, এই হামলার প্রতিবাদে সিলেটের মহিলারা ১৯৪৭ সালের ১০ মার্চ গোবিন্দ পার্কে একটি সভা আহবান করেন। কিন্তু এই সভা আয়োজনের আগের রাতে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম. ইসলাম চৌধুরী সমগ্র সিলেটে সভা সমাবেশ আয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করেন। এত সব বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে সিলেটর মহিলারা ভাষা আন্দোলন অব্যহত রেখেছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাকে দেয়া সংবর্ধনা সভায় ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অভিমতকে পুনর্ব্যক্ত করেন। তখন সিলেটের মহিলারা জিন্নাহকে তারবার্তা পাঠিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবী জানান।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র, জনতা হত্যার প্রতিবাদে সিলেটের নারী সমাজ আবারো প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ঢাকায় পুলিসের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদরের প্রতি শ্রদ্ধা জনান। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিছিলে সিলেটের মহিলারা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়ে বেলা ১১টায় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। মিছিলটি গোবিন্দ চরণ পার্কে এসে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন সিলেচের মাহিলা ও ছাত্রী নেত্রীবৃন্দ। পর দিন’ই মুসলিম সাহিত্য সংসদ হলে (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) এক মহিলা সমাবেশ করেন এবং বিকালে গোবিন্দচরণ পার্কে সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী-শিক্ষকদের আয়োজনে কলেজের অধ্যাপক আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার দাবিতে বিরাট জনসভা। ভাষা আন্দোলনে মহিলাদের মধ্যে সিলেটে আরো ভূমিকা রাখেন যারা তারা হচ্ছেন বেগম রাবেয়া আলী, ছালেহা বেগম, লুৎফুন্নেছা বেগম। নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্ত্রী মিসেস রাবেয়া আলী, অধ্যাপক শাহেদ আলীর স্ত্রী বেগম চমন আরা, সরকারি চাকুরে হয়েও স্বামীর মতো ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে তিনিও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মিসেস লুৎফুন্নেছা বেগমের স্বামী সেনা বিভাগের কর্মকর্তা হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

সিলেটের কুলাউড়ার মেয়ে সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী স্কুলের সামনে কালো পতাকা উত্তোলণ করেন। ছাত্রী সালেহা বেগমের এই সাহসী উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয়অপরাধ আখ্যা দিয়ে পাকিস্থান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহের ডিসি ডি কে পাওয়ারের আদেশে স্কুল থেকে তাঁকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।সালেহা বেগমের পক্ষে আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তিনি হচ্ছেন ভাষা আন্দোলনের ‘শিক্ষাজীবন’ শাহাদতকারী একমাত্র ছাত্রী।

সিলেটের আরেক ভাষা সৈনিক কন্যা রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা কালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের অন্যতম অদমনীয়নেত্রী ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এএম আরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্ট’ এ যোগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস্ রেসিডেন্স এর সদস্য নির্বাচিত হন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২০ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হলে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এ সময় যেসব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাই আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেন রওশন আরা বাচ্চু তাদের অগ্রভাগে ছিলেন। ২১ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আহূত ছাত্রজনতার সমাবেশে ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয় সহ অন্যান্য স্থান থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে সমাবেশস্থলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যারা কাজ করেছেন রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ।

রওশন আরা বাচ্চু সাহসী নেতৃত্বে এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন।তারা পুলিশের কাটাতারের ব্যারিকেড টপকিয়ে মিছিল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেন।কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে কাটা তারের ব্যরিকেড টপকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সংকটময় সময়ে বজ্রকণ্ঠে স্বপথ নিয়ে রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি এই অতিক্রম-অসাধ্য ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন।।এরপর পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলি বর্ষণ শুরু করে দেয়।এতে আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বারওশফিউর রহমান শাহাদাত বরণ করেন এবং রওশনআরাবাচ্চু সহ অনেক ছাত্রী গুরুতর আহতহন।

সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণে সিলেটের এই ভাষাসৈনিক নারী নেত্রী রওশন আরা বাচ্চু বলেন, “সকাল দশটার দিকে দেখি একটি জিপ এবং ৩/৪টি ট্রাক এসে দাড়ালো এবং পুলিশ বাহিনী ইউনিভার্সিটির গেটটা ঘেরাও করলো। পুলিশ আমাদের মিছিলে লাঠিচার্জ করলো। অনেক মেয়ে আঘাত পেলো, আমিও আঘাত পেয়েছিলাম। আমরা দৌড়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো স্মারকলিপি পৌছে দেয়া। কিন্তু আমাদের পথে মেডিকেলের মোড়েই তখন শেল পড়ছে, চারদিক কাদুনে গ্যাসে অন্ধকার। তখন আবার গুলির শব্দ পেলাম। এরপর তার কাটার বেড়া পার হয়ে ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা শামসুন। তারা আমার এ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে এগিয়ে এল। ” সিলেটের সুনাম গঞ্জের অধ্যাপক শাহেদ আলীর সহধর্মীনি বেগম চেমন আরা প্রথম সারির একজন মহিলা ভাষা সৈনিক।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাবস্থায় স্বামী অধ্যাপক শাহেদ আলীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের করে ছিলেন তাতে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এভাবে অন্যান্য জেলার তুলনায় সিলেট শহরে এবং ঢাকায় অবস্থানরত সিলেটের নারীরা ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছিলেন, যা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইল ফলক।

নুরুল ইসলাম
টরন্টো, কানাডা