ভাষা মানব জাতির আত্মপরিচয়ের বাহন। একটি জাতির হাজার বছরের পথ-পরিক্রমায় মানবিক অস্তিত্বের মৌলিক চেতনা ভাষার মধ্যেই আশ্রয় লাভ করে। বাঙালি জাতির প্রায় ছয় হাজার বছরের আত্ম অন্বেষা, যুথবদ্ধ জীবন অভিধায় সম্মিলিতমানবিক জীবনযুদ্ধে প্রতিষ্ঠালাভের অন্যতম হাতিয়ার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।আবহমান বাঙালি জীবনে মাতৃভাষার অবদান অনস্বীকার্য। মূর্তিমান মহাজগতে পারস্পরিক সংযোগ রক্ষার অন্যতম মাধ্যম ভাষা। মহাজগতে অভূতপূর্ব নান্দনিক বৈভবে সৃজনশীলতায় চিরবর্ধিষ্ণু সৃষ্টির বিকাশ বিজ্ঞানে ভাষা মানুষের অস্তিত্ব বিনির্মাণের প্রথম হাতিয়ার। প্রাগৈতিহাসিক যুগে অন্ধকার পহাড়ের গুহায় ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে আমাদেরপূর্বপুরুষেরা ভাষা নির্মাণের শুভ সূচনা করেছিল। মানুষের সুদীর্ঘ অধ্যাবসয় আর সাধনার ফসল আজকের পৃথিবীর বিভিন্নভাষার লেখ্যরূপ।

মাতৃভাষার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা আর হৃদ্যতা বাঙলার মানুষকে বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মাতৃভাষার জন্য এই বাঙালিরা ছাড়া বিশ্বের আর কোন জাতিকে আত্মবিসর্জন দিতে হয়নি। অনেকদিন আগে থেকেই তাই এদেশের লোক-কবিরা তাঁর মাতৃভাষার মাধ্যমে মানব জীবনের সর্বোচ্চ মানবিক বিশ্বজয়ী শ্লে¬াগানে বিশ্বদরবার মুখরিত করেছেন। তাঁরা ঘোষণা করেছেন- ‘শোন হো মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, বিশ্ব মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি ’হ, গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।’

শতাব্দী লাঞ্ছিত বাংলার মানুষকে আজন্ম লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদেশী বেণিয়া লুটেরাদের শাষণ-শোষণের সর্বশেষ আঘাত নেমে আসে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকে পূঁজি করে দেশ বিভাগের পর। একদিকে ভারত ও অন্যদিকে পাকিস্তান তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন সময়ে এদেশের অনেক নেতৃত্বই এই বিভক্তিকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা হাজারও বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ছয় মাস বারো দিন পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর এই মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে চেতনার মশাল হয়ে দেখা দেয় স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি।

আমাদের ভাষা বেঁচে থাকে আমাদের লেখায়, কথায় আর পড়ায়। আর আমরা বেঁচে থাকি আমাদের ভাষায়। আমরা বড় সৌভাগ্যবান এই জন্য যে, আমাদের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, আছে দিন এবং মাসের নাম। আছে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি যা পৃথিবীর অনেক জাতিরই নেই। আমাদের আছে ছয়টি নিজস্ব বৈচিত্রময় ঋতু। ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা?’ আমার দুঃখিনী বর্ণমালা অনেক বন্ধুর পথ বেয়ে আজ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে হিমালয় থেকে সুন্দরবনের হৃদয় জুড়ে। তাকে উপড়ে নিলে বল তবে, কি থাকে আমার ?
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে ঊজিরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন ঊর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই ঘোষণার বিরোধিতা করে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত স্কুল কলেজে হরতাল ডাকে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারার প্রতিবাদে এদেশের ছাত্রসমাজ সফল হরতাল পালনের মাধ্যমে প্রত্যাশা করেছিল পাকিস্তানি শাষক গোষ্ঠীর বোধোদয় হবে এবং তাদের গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটবে। কিন্তু তা আর ঘটতে দেখা যায়নি। এর মাত্র নয়দিন পর ১৯৪৮ সালের ২৫মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সকলকে হতবাক করে দিয়ে ঘোষণা করে ‘ঊদু এবং ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।

জীবনকে বাজী রেখে ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করে। সেই থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। আর এই আন্দোলনে দেশের অন্যান্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আরেকজন মহানায়কের নামও যুক্ত হয়। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু। তিঁনি শুধু বাঙালির জাতির জনকই নন, একই সাথে ভাষা সৈনিকও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া, তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ।’ তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তরুণ শিক্ষার্থী শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন কর্মী ও সংগঠক। ভাষা আন্দোলনে তার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গঠিত তমুদ্দিন মজলিসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা দিয়ে। আবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মকা-েও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচিতে যুক্ত থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজেও অংশগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষার দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান মিছিল-মিটিং করেছেন, অনেক মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অনেক সমাবেশের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করেছেন। ভাষাপ্রেমে বলীয়ান মুজিব ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনের অভিমুখে যাওয়া মিছিলের নেতৃতও¡ দেন। এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানগ্রেফতারও হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। এই ধর্মঘটে অংশ নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ মার্চ গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় রওনা দেন। পরেরদিন ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। পুলিশ সকাল ৯টায় তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পরেই তিনি মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে মুক্ত হয়ে ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সংগঠিত প্রায় প্রতিটি সভা, মিছিল, মিটিংয়ে তিনি সক্রিয় সংগঠক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ১৯৪৯ সালে তিনি আরও দুইবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে তাকে ১৯৫২ সালের আগে আর মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রয়ারি ভাষা আন্দোলনের পর জেল থেকে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। যার কারণে তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু তিনি জেলে থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে নানারকম পরামর্শ দিতেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। ফলে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তির দাবিতে পত্রিকায় বিবৃতিও প্রদান করেন।

কিন্তু এর পূর্বে ১৯৪৭ সালে করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার জন্য সুপারিশ করা হয়। ফলশ্রুতিতে সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পাকিস্তানের সরকার। একই সঙ্গে সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে বহুমুখী উদ্যোগ নিলে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে বাংলা ভাষার দাবিতে সভা সমাবেশ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মিসভায় ভাষাবিষয়ক কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। সেদিন সবার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন : ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তইই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ কর্মী সম্মেলনে এই প্রস্তাব থেকে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয়ভাবে তৎপর ছিলেন এবং এ আন্দোলনকে বেগবান করতে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

বিশেষভাবে বাঙালির আরেক জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা বলতেই হয়। প্রথমেতিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে ছিলেন না। ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বিবৃতি দিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেষ্টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্তবাংলা ভাষার পক্ষে অবস্থান নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে উর্দুর পক্ষে দেওয়া বিবৃতি প্রত্যাহার করে বাংলা ভাষার পক্ষে পূনরায় বিবৃতি দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জবানিতে এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষাসংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ওই বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাকে বিবৃতি দিতে বলি।’ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার সমর্থনে সোহরাওয়ার্দীর দেওয়া ওই বিবৃতিটি ২৯ জুন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। এটিও ভাষা আন্দোলনের একটি বিশেষ ঘটনারঅন্তর্ভূক্ত। ১৯৫৩ সালে ভাষা শহীদদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঅবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৬ সালের আইন পরিষদের অধিবেশনে সংসদের কার্যসূচি বাংলায় লিপিবদ্ধ করার আহ্বান জানান। একই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের অধিবেশনে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু হবে।’ ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম সংবিধান রচনা করা হয়। এই সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে তিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেন। তিনি ওই বক্তব্যের শুরুতেই উল্লেখ করেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন।’ সেই অধিবেশনে পৃথিবীর দেশবরেণ্য নেতারা মাতৃ ভাষা আর স্বদেশ প্রেমের অসামান্য নজির দেখে বিস্মিত হয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দিত করেছেন। এছাড়াও১৯৫২ সালে চীনে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করেন। ওই আদেশে বলা হয়, দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ তিন বছর পরেও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বাস্তবায়ন চেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও বাংলাদেশের আইন-আদালতসহ সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা ভাষার সার্থক ব্যবহারে সাফল্য অর্জন করতে পারি নি।মাতৃভাষা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্যক যে অবদান রয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সময় এখনই। এ ছাড়া আর কোন বিকল্পব্যবস্থা আজ আমাদের হাতে নেই।

একটি জাতিসত্ত্বার আত্মমুক্তির সামগ্রিক পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহাকালের সারথী হয়ে প্রথমে ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে একটি জাতির হাজার বছরের আত্মমর্যাদা অর্জনের লড়াই সংগ্রামকে যুথবদ্ধ মুক্তির সংগ্রামে সফলভাবে এগিয়ে নিয়েছেন। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় মহিমান্বিত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান আমাদের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য বিজয়গাঁথার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিঁনি জন্মগ্রহণ না করলে শুধু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধই নয় একইসাথে মহান ভাষা আন্দোলনও হয়তো ত্বরান্বিত হতো কী না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বরই শুধু নয়, একটি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকও ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বাংলা ও বাঙালির মুক্তিদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা একাডেমিতে প্রথম একুশের বইমেলা উদ্বোধন করেন। জাতির জনকের মতো তার কন্যা জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাও বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিতে জীবনকে বাজী রেখে চলেছেন।একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ক্রমশদেশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অসামান্য দূরদর্শী নেতৃত্বে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথ ধরে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করে চলেছেন। তাঁরই হাত ধরে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশেফেব্রুয়ারিকেআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আ-মরি বাংলা ভাষা এখন সারা পৃথিবীর মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর অনন্য স্মারক ভাষা। বাংলা এখন শুধু বাঙালিদের নয়, বাংলা এখন সমগ্র বিশ্বের, সকল মানুষের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা দশোধিকবক্তব্যবাংলা ভাষায় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সর্বাধিক একুশের গ্রন্থমেলা উদ্বোধনকারী রাষ্ট্রনায়ক। সিয়েরালিয়ন তাদের নিজস্ব ভাষার পাশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। তাদের একটি বাংলা টিভি চ্যানেলও রয়েছে। আমাদের ভাষার প্রতি তাদের এই সম্মানে আমরা নিশ্চয় কৃতজ্ঞতা জানাই।
এখন ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে বাঙালিদের অন্যতম একটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের সর্বস্তরে প্রমিত বাংলার প্রচলন করা। এই বিষয়টির প্রতিগুরুত্ব না দিলে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন থেকে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠঅর্জন মহান স্বাধীনতা লাভের এই অভূতপূর্ব বিজয়কে আমার ক্রমশ হারিয়ে ফেলবো। আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষার ভয়াবহ অধঃপতন দেখে কবি লিখেছেন- ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার ?উনিশশো’ বায়ান্নোর দারূণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলিবুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্ত্বার দিকে, কত নোংরা হাতের হিং¯্রতা ধেয়ে আসে, এখন তোমাকে নিয়ে খেংরার নোংরামি, এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস। তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

একুশ বাঙালির স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। একুশ আমাদের আবহমান সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সকল সৌন্দর্য্যরে মূল ভিত্তি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমরা আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ চেতনার সঙ্গে সবচেয়ে গভীর অন্তরঙ্গ ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করি একুশের সঙ্গে।
বাঙালির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ যার মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, একটি লাল সবুজ পতাকা, সে মুক্তিযুদ্ধ যুক্তির দিক থেকে বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে আবেগের দিক থেকে মুখ্যত ভাষা আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি আর সেই অভূতপূর্ব আবেগকে সূর্য সারথি হয়ে পথ দেখিয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বাংলা ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু যেন একইসূত্রে গাঁথা বাঙালির অনন্ত যাত্রপথের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য, বীরগাঁথা আর আত্মমর্যাদার উৎসমূল।

২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সকল ভাষাভাষি আজকের এই দিনে তাদের মায়ের ভাষাকে সম্মান জানানোর মহিমান্বিত গৌরবে অভিষিক্ত হবে বাংলা ভাষার অভূতপূর্ব বিশ্বনন্দিত ইতিহাসকে সামনে রেখে। সুতরাং, এই একুশ বাঙালির আত্মপরিচয়। একুশ বাঙালির প্রথম চৈতন্য। একুশ বাঙালির অন্ধকার আকাশের প্রথম আলোকিত সূর্য। যে সূর্য আজ আমাদের জাতীয় পতাকা।

অতএব, মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবান্বিত মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মাহেন্দ্র ক্ষণে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবের্ষর এই বিশেষ আবেগ ঘণ মুহূর্তে আসুন, শপথ গ্রহণ করি। বঙ্গবন্ধু কণ্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলা ভাষার ক্রমোন্নতি সাধনে সকলে মিলে তৎপর হই। ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে আসুন, সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি। শিশুদের মননশীলতাকে বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যিক আবহে মানসিক বিকাশে আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ শিক্ষা দেই। বর্তমানের ভার্চুয়াল জগত তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভুল বাংলার ব্যবহার বন্ধ করি। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এফ এম রেডিওগুলোতে বাংলিশ আর ভুল বাংলা ভাষার ব্যবহারকে রোধ করি।ভাষার মাসে শ্রদ্ধাভরে জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালবাসারঅঙ্গীকারে বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চার ক্ষেত্রকে বিকশিত করি। আমাদের চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-দীক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছদে ও জীবনদর্শনে বাঙালিয়ানার চর্চা করি। ধর্মান্ধতা নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের কাছে আমাদের কিছুটা হলেও ঋণ পরিশোধ করি।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ বেয়েই এসেছিল ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। একসাগর রক্ত পেরিয়ে, তিন লক্ষ মা-বোনের পবিত্র সমভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের মহান স্বাধীনতা। যার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বাংলা ভাষা, মহান স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু এখন বাঙালির হাজার বছরের মহিমান্বিত জীবন সংগ্রামের বিশ্বননিন্দত বীজয়ের অসামান্য কালজয়ীবীরগাঁথা। মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের এই রক্তরাঙা ভোরেবঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সূর্যালোকিত সৌরভে-গৌরবে সিক্ত বাঙালিত্বের মানবিক জয়কে ঋদ্ধ করতে আসুন,প্রমিত মাতৃভাষা বাংলাকে জীবনের সকল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারে শাণিত হই।সেই সাথে বাঙালি চেতনার অভূতপূর্ব অবিসংবাদিত অত্মমর্যাদার লড়াইয়ে উৎসমুখ মহান ভাষা আন্দালনে শাহাদত বরণকারী সকল বীর শহীদের নতশিরে প্রণতি জানাই। জয় বাংলা, জয়তু বঙ্গবন্ধু।

ড. হাসান রাজা
কবি, লেখক ও গবেষক
রাজশাহী।