প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের প্রেক্ষাপট দেশটির ইতিহাসের এক অরুণ অধ্যায়। যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষের
চাপিয়ে দেয়া‌ অন্যায় ও অন্যায্য চুক্তিসমূহ দেশটির অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। ভার্সাই চুক্তির
ফলে আবির্ভূত হওয়া ভাইমার প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার মুখে পড়ে। পুরো জার্মান সমাজ এক অবর্ণনীয়
দুর্ভোগের মধ্যে পতিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ঘাটতি, বেকার সমস্যা,
বাণিজ্য মন্দা, জনসংখ্যা সমস্যা, দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান সমস্যা জার্মান জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে
তোলে। জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার কালো মেঘ ঘনীভূত হতে থাকে যা তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা
প্রতিশোধের আগুনকে জাগিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে ইতালির ফ্যাসিস্টদের আদলে জার্মানিতে নাৎসি নামে এক
উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে।

National sozialismus অর্থাৎ জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল যা পৃথিবীব্যাপী নাৎসিবাদী(Nazism)
বা নাৎসি পার্টি নামে সমধিক পরিচিত। এটি একটি উগ্ৰ ডানপন্থী জার্মান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক
মতাদর্শ যা ইতালির ফ্যাসিবাদের সমপর্যায়ের রাজনৈতিক দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাৎসিবাদের মধ্যে
রয়েছে বৈজ্ঞানিক কৌলিবাদ ( Scientific Racism), ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাব ( Anti Semitism), ও
সাম্যবাদ ( Communism) বিরোধী অগণতান্ত্রিক চেতনা। আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে গেলে নাৎসিবাদ হলো
জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ও আদর্শের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদি যার
মূলমন্ত্র জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টির প্রতিষ্ঠার সাথে নিহত রয়েছে।

বিসমার্কের শাসনামলে জার্মানি পুরো পৃথিবী জুড়ে যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। জার্মান রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে যে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা
অচিরেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় পর্যাপ্ত রাজনৈতিক সমর্থনের অভাবে। প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে জার্মানিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে, প্রজাতন্ত্র বিরোধীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আঁতাত পাকাপোক্ত হতে থাকে, অর্থনৈতিক মন্দাসহ অন্যান্য কারণে তৎকালীন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের নেতা ফ্রেডরিক এর্বাটের প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, সরকারের পক্ষে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে বিদ্যমান সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, জনগণের অনুভূতিকে কাজে লাগাতে এডলফ হিটলার তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি জার্মানিকে তার হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন যা তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে
পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও
জাতীর স্বপ্নদ্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। হিটলার ও নাৎসি দল একে অপরের পরিপূরক হিসেবে
জার্মানির সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

হিটলারের নেতৃত্বে সুপ্রতিষ্ঠিত নাৎসি পার্টি সেসকল নীতিমালার অনুসরণ করত তা কিন্তু নব উদ্ভাবিত কোন
মতবাদ ছিল না। উদারতাবাদ, যুক্তিবাদ এবং মার্ক্সবাদ বিরোধী মতাদর্শের বিপরীতে জার্মান আর্য রক্ত,
জার্মান ভাষা ও সকল ধর্মীয় বিশ্বাসমুক্ত উগ্ৰ জাতীয়তাবাদী চেতনাই ছিল নাৎসি পার্টির ভৌতভিত্তি। নাৎসি
পার্টির মূল প্রতিপাদ্য ছিল- আর্য রক্তের ধারক জার্মানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি এবং পৃথিবীর নেতৃত্ব লাভের
অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে।

২৯২০ এডলফ হিটলার নাৎসি পার্টির জন্য পঁচিশ দফা সম্বলিত এক ইশতেহার জারি করেন যা তৎকালীন
জার্মানির জনমনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করে। আশাহত জার্মান সমাজের কাছে হিটলার একমাত্র ত্রাতা হিসেবে
অভিহিত হন। জার্মানির যুবসমাজ হিটলারের নাৎসি পার্টির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং দিনে দিনে
হিটলারের প্রভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। তিনি ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে
তার নাম পৃথিবীর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিনত হয়।

লেখক- আকতারুল ইসলাম