ভ্রমণ আমার একটি প্রিয় শখ। সময় সুযোগ পেলে কোথাও না কোথাও ভ্রমণে বের হয়ে যাই। তেমনি গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার আর ২২ শে ফেব্রুয়ারী শুক্রবার এই দুইদিন বন্ধ, সাথে ১৯ ও ২০ তারিখ আরো দুদিন ছুটি নিয়ে দুই বন্ধু মিলে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনোশিয়ার বাটাম আইল্যান্ড ভ্রমণ করে এলাম। আমরা যারা ভ্রমণ করি তারা সবাই কমবেশি সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে এসেছি, তাই সিঙ্গাপুর নিয়ে এবার কিছু লিখবো না। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা সিঙ্গাপুরের খুব কাছেই সমুদ্রপথে মাত্র ১ ঘন্টা সময় পাড়ি দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার বাটাম আইল্যান্ড পৌঁছানো যায়। যেহেতু ইন্দোনেশিয়াতে বাংলাদেশীদের বিনামূল্যে অন-এরাইভাল ভিসা দেয়া হয়, তাই যে কেউ ইচ্ছা করলেই একদিনে বা ভালো করে দেখতে চাইলে দুইদিনে সিঙ্গাপুর থেকে নৌপথে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত অপূর্ব সুন্দর বাটাম আইল্যান্ড দেখে আসা যায়। যদিও এর আগে ইন্দোনেশিয়ার বালি ঘুরে এসেছি, কিন্তু এবার সিঙ্গাপুর থেকে সমুদ্র পথে ইন্দোনোশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। নৌপথে ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপ এর সাথে সিঙ্গাপুরের খুব ভালো যোগাযোগ আছে। সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ উপকূল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপ এলাকার আয়তন প্রায় সিঙ্গাপুরের সমান। সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের ২ ঘন্টা সময়ের ব্যবধান, আর ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান ১ ঘন্টা।

সিঙ্গাপুরে আমাদের হোটেল ছিল মুস্তফা সেন্টারের পাশেই। পূর্ব পরিকল্পনা মতো আমরা ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে ফেরার পার্ক এমআরটি স্টেশন থেকে পাতাল রেলে সোজা চলে আসলাম হারবারফ্রন্ট স্টেশনে। হারবারফ্রন্ট থেকে প্রথমে পাসপোর্ট ও সিঙ্গাপুরের ডাবল এন্ট্রি ভিসা দেখিয়ে ৪৯ সিঙ্গাপুর ডলারে রির্টান টিকেট কেটে ইমিগ্রেশন শেষ করে নিদ্দিষ্ট ওয়েটিং রুমে বসলাম। কিছুক্ষন পর আমাদের ফেরিতে (যাত্রীবাহী নৌযান) বোর্ডিংয়ের ঘোষণা এলো। আমরা টিকেট দেখিয়ে জেটির দিকে রওনা করলাম। সুন্দর পরিষ্কার পরিপাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কোচ সমৃদ্ধ ফেরিতে উঠে বসলাম। নিদ্দিষ্ট সময়ে ফেরি যাত্রা শুরু করলো। এখানে উল্লেখ্য যে, বাটাম গিয়ে আবার সিঙ্গাপুর ফিরে আসতে হলে বাংলদেশ থেকে ডাবল এন্ট্রি ভিসা নিয়ে যেতে হবে। সিঙ্গাপুর থেকে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত সারাদিনই প্রতি ১৫ মিনিট পরপর ফেরি ছেড়ে যায় আবার একই নিয়মে ফিরে আসে।

স্বচ্ছ পানির সমুদ্রের বুক চিরে সমুদ্র থেকে একপাশে সিঙ্গাপুর শহর ও অন্য পাশে ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মাত্র এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ইন্দোনেশিয়ার বাটাম জেটিতে। জেটির দিকে জাহাজ আগাতেই অর্থাৎ সমুদ্র থেকে চোখে পড়ে বাটামের পাহাড়ের গায়ে বড়করে লেখা “ওয়েল কাম টু বাটাম”। ইমিগ্রেশন সিস্টেম দেখে মনে হলো এটাও যেন সিঙ্গাপুর। খুব দ্রুততার সহিত লাইন ও শৃংখলার সাথে সব কিছু শেষ হলো। ইমিগ্রেশন শেষে এগোতেই বাটাম সেন্টারের মধ্যেই চোখে পড়লো ইনফরমেশন সেন্টার, মানি এক্সচেঞ্জ, খাবারের দোকান, কাপড়ের-কসমেটিকস-জুয়েলারি সহ বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। আমরা ইনফরমেশন সেন্টার থেকে আইল্যান্ডটি সম্পর্কে ধারণা নিলাম, তারপর সিন্ধান্ত নিলাম ধারাবাহিক ভাবে বাটামের প্রধান মসজিদ, নোংসা বিচ ও রিসোর্ট, নাগোয়া, কোস্টারিনা দেখতে যাবো। ইনফরমেশন সেন্টার থেকে দেখিয়ে দিলো টেক্সি ভাড়া করার কাউন্টার। আমরা ডলার ভাঙ্গিয়ে নিলাম, আর লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে গেলাম। মানি এক্সচেঞ্জে ১০০ ইউএস ডলার ভাঙ্গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ১৩,৪০,০০০ রুপি পেলাম। টাকার মান কম হলেও তাদের অর্থনীতি নড়বড়ে নয়, শক্ত ভীতের উপর দন্ডায়মান।

ইন্দোনেশিয়া হাজারো দ্বীপের একটি দেশ। বালি ও জাকার্তার পরেই তৃতীয় ব্যস্ততম প্রবেশদ্বার হলো বাটাম। এটি সেদেশের অষ্টম বৃহত্তম শহর। বাটাম দ্বীপ সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ত্রিদেশীয় বিনিয়োগ সমৃদ্ধ ফ্রি ট্রেড জোন বিধায় জিনিসপত্রের দাম সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম। এখানে জাহাজ শিল্প ছাড়াও বহু ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাষ্ট্রি রয়েছে। যদিও উন্নত বিশে^র সারিতে ইন্দোনেশিয়ার নাম নেই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশটি উন্নতও নয়, তবুও এদেশটি ভীষণ রকমের সুন্দর ও সমৃদ্ধ। পর্যটন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভর করে দেশটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মূলত সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে আসা বিদেশী পর্যটক ও সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার জনগণই বাটামে বেশি বেড়াতে আসে। এখানে শপিং, খাওয়া, থাকা ও বেড়ানোর খরচ খুব কম। বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য রয়েছে অনেক সমুদ্র, বিচ, পাহাড় বন, মার্কেট, হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, বার, নাইট ক্লাব, ম্যাসাজ পার্লার ইত্যাদি। বাটামে চকোলেট, পোশাক, টুপি, জুতা, ব্যাগ, প্যাকেটজাত খাবার, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, মশলা ইত্যাদি পণ্যের ব্যাপক সমাহার ও দামেও সিঙ্গাপুরের তুলনায় সস্তা।

একটা টেক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম বাটামের সৌন্দর্য দেখতে। বাটাম সেন্টারের ঠিক পাশেই অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত হাইপারমার্কেট শপিং সেন্টার। অনেক বড় ও আধুনিক একটি শপিং মল। বিশ^খ্যাত প্রায় সকল ব্র্যান্ড পণ্যের (পোশাক, জুতা, কসমেটিকস, খাবার) পাশাপাশি স্থানীয় পণ্যের অনেক সমাহার রয়েছে। বাটাম সেন্টারে রয়েছে সেখানকার বেশিরভাগ সরকারি অফিস আদালত। সুন্দর গোছালো পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, হোটেল, মার্কেট, মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে দেখতে চলে এলাম বাটামের প্রধান মসজিদের সামনে। এটির নাম হলো ’মসজিদ রায়া’, খুব সুন্দর একটি স্থাপনা। ভিতরে সাড়ে তিন হাজার আর বাইরের এলাকা মিলিয়ে ১৫ হাজার মুসল্লি একসাথে নামাজ পড়তে পারে। পিরামিড আদলের অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর গম্বুজই মসজিদটিকে বিখ্যাত করেছে। তার পাশের পাহাড়ে গায়ের সেই “ওয়েল কাম টু বাটাম” লিখাটা খুব কাছ থেকে দেখলাম। এবার আমরা নোংসা বিচের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তাঘাটে লেটেষ্ট মডেলের জাপানি, বৃটিশ এবং আমেরিকান গাড়িও দেখা যায়। তবে শহরটিকে মনে হলো যেন মটর সাইকেলের শহর। সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে। গাড়ীতে কোন হর্ন বাজানো হয় না।

প্রায় আধঘন্টা জার্নির পর নোংসা পয়েন্ট মেরিনা রির্সোটের প্রধান ফটক দিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলাম। শুরতেই ডানদিকে চোখে পড়লো একটা দৃষ্টিনন্দন গলফকোর্স আর বাম দিকে রির্সোটের নয়নাভিরাম ফুলফলের বৃক্ষ ঘেরা কটেজগুলো দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম শান্ত নীল জলরাশির সমুদ্র তীরে। সাদাবালির সৈকতে শান্ত নীল জলরাশির সমুদ্র, কাঠের পাটাতনে তৈরী অস্থায়ী জেটিতে ভিড়ানো প্রমোদতরণী (ইয়ট), কংক্রিটের বাঁধানো সমূদ্র তীরে নারকেল গাছের সারি, তার পাশে খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত রেঁস্তোরা, স্থলভাগে রিসোর্ট, সুইমিংপুল, এককথায় পশ্চিমা ধাঁচে তৈরী অসাধারণ সুন্দর একটা পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট। রিসোর্টের সামনে ইসমাইল নামে একজন কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হলো। পরিচয় দিয়ে বললাম আমরা বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছি। সে জানালো, বাংলাদেশ সস্পর্কে সে জানে ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশে, তাই আগ্রহ নিয়ে কথা বললো। তার থেকে জানলাম রিসোর্ট সম্পর্কে। সে জানালো প্রমোদতরণীগুলোতে রয়েছে হোটেলের মতো থাকার ব্যবস্থা, রেস্টুরেন্ট, বার সহ অনেক ব্যবস্থা। সারা বছরই কম বেশি গেস্ট থাকে, পশ্চিমা দেশের গেস্ট বেশি আসে। আশেপাশে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ আছে বিধায় এই বিচের জলরাশি শান্ত প্রকৃতির। যেহেতু আমাদের হাতে সময় কম, অর্থাৎ একদিনের ভ্রমণ তাই কিছু সময় সেখানে বেড়িয়ে রওনা করলাম বাটামের মূল কেন্দ্র নাগোয়া অভিমুখে।

প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের ভ্রমন শেষে আমরা নাগোয়ায় পৌঁছিয়ে গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করে দিলাম। নাগোয়া বাটামের মূল কেন্দ্র। এখানে ছোট বড় অনেক শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, নাইট ক্লাব, ম্যাসেজ পার্লার রয়েছে। আমরা নাগোয়া হিলে মাতাহারি শপিং সেন্টার ঘুরে দেখলাম। বিশ^খ্যাত প্রায় সকল ব্র্যান্ড পণ্যের (পোশাক, জুতা, কসমেটিকস, খাবার) পাশাপাশি স্থানীয় পণ্যের অনেক দোকান রয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে মিনিট তিনেক পায়ে হেঁটে চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। এ জায়গাটাও জমজমাট, এটাই নাগোয়ার সবচেয়ে বড় চৌরাস্তা। আশেপাশে অনেক দোকান, রেস্টুরেন্ট। আমরা রাস্তা পেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম দুপুরের খাবার খেতে। এই রেস্টুরেন্টে ইউরোপিয়ান, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায়। আমরা ফ্রেশ হয়ে খাবার অর্ডার করলাম সী-ফিশ (রূপচাঁদা) বিরিয়ানি। খাবারটা খুবই সুস্বাদু ছিল। খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে পরিচয় হলো এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সাথে। কথা বলে জানা গেলো পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়াতে এসে আমাদের মতো বাটামে বেড়াতে এসেছেন। উনারা দুদিনের জন্য এসেছেন। ভালোই লাগলো দেশি লোকজন পেয়ে, কিছুক্ষন গল্প করে বিদায় নিয়ে যার যার মতো আশেপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।

নাগোয়া থেকে বিকেলে রওনা করলাম নিও-কোস্টারিনা অভিমুখে। নাগোয়া থেকে টেক্সিতে প্রায় মিনিট পনোরোর মতো লাগলো সেখানে পৌঁছাতে। সমুদ্রতীরে অবস্থিত নিও-কোস্টারিনা একটি বিশাল এমিউজমেন্ট পার্ক। পার্কটিতে প্রবেশের মুখে সাগরের তীর ঘেঁষে রাস্তার পাশে রয়েছে ড্রাগন, সিংহ, ঘোড়া, গোখরা, গরু, মোরগ সহ অনেক প্রাণীর বড় বড় স্ট্যাচু। পার্কটি থেকে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে চলা সিঙ্গাপুর বাটামের চলমান ফেরি, মাছ ধরার বোটগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আমরা ফিরে চললাম বাটাম সেন্টারের দিকে সিঙ্গাপুরে ফিরে আসার জন্য। যেহেতু আমাদের ভ্রমণটা ছিল একদিনের তাই বাটামের আরো অনেক জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম না। যার মধ্যে রয়েছে বাটামের বিখ্যাত রেয়ারলাং ব্রিজ (ঝুলন্ত ব্রিজ), টুয়া প্যাং কোং বৌদ্ধ বিহার, দুতা বৌদ্ধ মন্দির উল্লেখযোগ্য। দুইদিন থাকলে পুরো বাটাম ভালোভাবে ঘুরে দেখা সম্ভব ছিল। বাটামের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, মার্কেট, পর্যটন এলাকা তথা সর্বত্রই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর। সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার দেখেছি, কিন্তু রাস্তাঘাট বা খোলা জায়গায় ছুড়ে ফেলে দেয়া কোনো পলিথিন দেখিনি। সেদেশের জনগণ নিদ্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলে। সবক্ষেত্রে তারা নিয়ম মেনে চলে।

এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ

চাকুরীজীবি ও কলাম লেখক