বিশে^র অন্যতম অপরূপ সুন্দর দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের হাজার হাজার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম ও প্রধান দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবন হল বিশে^র সবচেয়ে সুন্দর ও সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। যা ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ^ ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি লাভ করেছে। এটি প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে ফাইনালিষ্ট তালিকায়ও ছিলো। আগে কখনো সুন্দরবন ভ্রমনে যাওয়া হয়নি। তাই গত ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের ৪-৭ তারিখ একটি ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চে করে সুন্দরবন ভ্রমনে গিয়েছিলাম। পেলিকেন-১ নামক একটি টুরিস্ট লঞ্চ ছিলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমনের বাহন। পরিপাটি লঞ্চ, লঞ্চের পরিচ্ছন্ন কেবিন, চমৎকার আতিথেয়তা, আপ্যায়ন ও ব্যবস্থাপনা আমাদের মুগ্ধ করেছে। ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেল ৪ টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ট্যুর অপারেটরের উদ্যোগে সবার সাথে সবার পরিচয় হলো। লঞ্চটিতে ১জন জাপানী, ১জন ইংরেজ ও ২২জন বাংলাদেশী মিলে মোট ২৪জন পর্যটক ছিলাম। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আগত এডভোকেট রফিকুল আলম ভাই, আমেরিকান লাইফ ইন্সুরেন্সের ওয়াহেদ ভাই ও ব্যবসায়ী শিপলু ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। একই এলাকার হওয়ায় সুন্দরবন ভ্রমনের এই সময়টুকু চারজনে একসাথেই উপভোগ করেছি।

এই সময় সুন্দরবন যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে- ৬ই নভেম্বর ছিল ভরা পূর্ণিমায় সুন্দরবনের দুবলারচরের রাস উৎসব/রাসমেলা/রাস পূর্ণিমা উৎসব। যা মূলত রাস মেলা নামে পরিচিত। এদিন প্রায় সারাবছর জনমানব শূন্য থাকা এই চরটিতে হাজার হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী সহ অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমান। রাস মেলা সনাতন ধর্মবলম্বীদের উৎসব হলেও, সকল ধর্মের মানুষ উৎসবটি উপভোগ করতে এই সময় সুন্দরবনের দুবলারচরে আসেন। শুধু তাই নয়, আমরা ভারত ও শ্রীলঙ্কার সনাতন ধর্মবলম্বীদেরও পেয়েছি, যারা সমুদ্র পথে এখানে এসেছে রাস মেলায় যোগ দিতে ও পূর্ণস্লান করতে।

এই ভ্রমনটি সরাসরি ঢাকা থেকে নদী পথে হওয়ায় অনেক ধরনের মজার ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিলো। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ তা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে না গেলে বোঝাই যাবে না। অনেকগুলো নদীর সাথে পরিচয় হয়েছে। নদীগুলোর বুকের মধ্যে দিয়ে পর্যটন লঞ্চে ভ্রমনের মজাই অন্যরকম। যে নদীগুলোর সাথে পরিচয় হলো সেগুলো হচ্ছে- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ^রী, পদ্মা, মেঘনা, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, গাবখান, সন্ধ্যা, কালছা/কাটছা, বলেশ^র, সুন্দরবনের সুপতিখাল, কটকা খাল, পশুর নদী, রূপসা নদী অন্যতম। নদী, নদীর তীর, নদীর পানি, জোয়ার-ভাটা, কচুরিপানা, মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার, কার্গো, যাত্রবাহী লঞ্চ, ফেরীঘাট ইত্যাদি নদীর সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

টেলিভিশনে একবার একটি মোবাইল অপারেটরের এই বিজ্ঞাপন চিত্রে লঞ্চের চরে আটকা পড়ার দৃশ্য দেখেছিলাম। এই যাত্রাপথে সুন্দরবনের সুপতি প্রবেশ পয়েন্টের কাছাকাছি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজারের কাছাকাছি এলাকায় বালেশ^র নদীর মাঝামাঝিতে আড়াআড়ি ভাবে নদী পাড়ি দেয়ার সময় একটি ডুবোচরে আমাদের লঞ্চটি হঠাৎ একটি ঝাকুনি খেয়ে আটকা পড়ে বা থেমে যায়। লঞ্চটিকে ডুবোচর থেকে উদ্ধার করার জন্য লঞ্চের মাস্টার লঞ্চটিকে পিছনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলে হঠাৎ করে লঞ্চটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষন পরে লঞ্চের মাস্টার জানালেন একটি যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। তখন ট্যুর অপারেটর ম্যানেজার বাবুল সাহেব আমাদের সামনে রায়েন্দা বাজারের উনার পরিচিত একজনকে ফোন করে একটি ট্রলার আনতে বললেন। প্রায় আধ ঘন্টা পর একটি ট্রলার আমাদের লঞ্চের নিকট আসলো। ততক্ষণে লঞ্চের নষ্ট যন্ত্রাংশটি মাস্টার ও ড্রাইভার মিলে খুলে ফেলেছে। বাবুল ভাই, লঞ্চের মাস্টার ও ড্রাইভার সহ নষ্ট যন্ত্রাংশটি নিয়ে রায়েন্দা বাজারের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন এবং বলে গেলেন ঘন্টা খানেকের মধ্যে যন্ত্রাংশটি ঠিক করে ফিরে আসবেন। আমরা সুন্দরবনগামী সকল যাত্রীরা তার কথায় আশ^স্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তখন বিকাল প্রায় সাড়ে চারটা।

ডুবোচরে জলযানে আটকে পড়ে আমরা, চারদিকে শুধু নদী আর দূরে নদীর তীর। ভাটার টানে ডুবোচরটি ততক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কোন যাত্রীবাহী বা মালবাহী লঞ্চ বা কার্গোর দেখা পাচ্ছি না। অনেক দূর দিয়ে দু একটি ট্রলার মাঝেমাঝে চলাফেরা করছে। সুর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসছে। নদীর মধ্যে সবাই সুর্যাস্ত উপভোগ করলাম। চারদিকে ধীরে ধীরে আবছা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশে মিলেছে চাঁদের দেখা। কিন্তু যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো সবাই কিছুটা বিচলিত ছিলো সময়মতো ভ্রমন করতে পারবে কিনা এই চিন্তায়। আমাদের মধ্যে একজন বাবুল ভাইকে ফোন করে জানালো-লঞ্চের যন্ত্রাংশটি মেরামত হয়ে গেছে, কিছুক্ষন পরে তারা রওনা দিবে। ততক্ষণে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা কি সাড়ে সাতটা। আমরা তখন কিছুটা দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম। সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ আমাদের লঞ্চের কাছাকাছি একটি ট্রলারের শব্দে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এর মধ্যেই বাবুল ভাইকে আমরা ফোন দিলে বাবুল ভাই জানালো- তারা আমাদের লঞ্চের কাছাকাছি চলে এসেছে। তখন সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। অবশেষে আমাদের লঞ্চ মেরামত সম্পন্ন হলো, কিন্তু জোয়ারের পানি পর্যাপ্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। রাত সাতে নয়টার দিকে জোয়ারের পানি বাড়ায় আমরা উদ্ধার হলাম।

আমাদের লঞ্চ আবার চলতে শুরু করলো। চাঁদনী রাতে নদীর জলে জোছনা আছড়ে পড়ছে। রাত ১১টার দিকে আমরা সুন্দরবনের সুপতি পয়েন্ট দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করলাম। রাতে সুন্দরবনের তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। রাত বাড়তে থাকায় আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমরা কটকায়। লঞ্চের কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখি কটকার খালে ৫০/৬০টি পর্যটকবাহী লঞ্চ, ট্রলার ও ইঞ্চিনচালিত বড় নৌকা। খালের পশ্চিম তীরের বনে চিত্রা হরিণের পাল। নদীর তীরের জঙ্গলে বুনো হরিণের বিচরণ দেখতে খুবই সুন্দর লাগলো। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কিট খেয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চড়ে খালের মধ্যে দিয়ে কটকার জঙ্গল ভ্রমনে বের হলাম। পর্যটকদের সুবিধার জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন জনপ্রিয় স্পটে নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শরণখোলা রেঞ্জের অধীন সমুদ্রের তীরবর্তী এক সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র কটকা অভয়ারণ্য। এখানো প্রায় দেখা মেলে সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। তবে বনে বাঘের দেখা মেলা ভার। তার ওপর বাঘের দেখা মিললেও নিজের নিরাপত্তা বিষয়টিতো আছেই। তবে বাঘ দেখা ও নিরাপদে থাকা- এ দুই-ই সম্ভব সুন্দরবনের চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র কটকা অভয়ারণ্য থেকে। যদিও আমরা বাঘের দেখা পাইনি। কটকা বন কার্যালয়ের ঠিক ওপারে একটি ছোট খাল চলে গেছে সোজা পূর্ব দিকে। এই পথে কিছু দূর যাওয়ার পরে হাতের ডানে ছোট্র জেটি এবং ওপরে ওয়াচ টাওয়ার। কটকার ওয়াট টাওয়ারটি চারতলা বিশিষ্ট। ৪০ ফুট উচ্চ টাওয়ার থেকে উপভোগ করেছি সুন্দরবনের অপার প্রাকৃতি সৌন্দর্য্য। একটি সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে এখানে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে ফেরার সময় হেঁটে বীচের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। এছাড়া কটকার জেটির উত্তরে চরজুড়ে থাকা কেওড়ার বনেও দেখা মিললো নানা জাতের পাখপাখালি, বানর আর শূকরের। আবার শীতের সময় দেখা মিলে যেতে পারে রোদ পোহানো লোনা জলের কুমির।

সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বন্যশুকর, বানর, কুমির, ডলফিন, কচ্ছপ, উদবিড়াল, মেছোবিড়াল ও বনবিড়াল সহ রয়েছে ৩৭৫ এর অধিক প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। সেই সাথে সুন্দরবন জুড়ে জালের মতো থাকা প্রায় ৪৫০টি ছোট বড় নদী-খাল ভ্রমনের অপার সুযোগতো রয়েছেই ভ্রমনপিপাসুদের জন্য। ২০০৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে তীব্র আক্রোশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। সেই থেকে দীর্ঘ আট বছর, সময় নেহায়েত কমও নয়। কিন্তু এতো বছরেও সিডরের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গোলপাতা, গেওয়া, গামারি, ঝামটি গরান এবং কেওরা সহ সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

কটকা সৈকত, হরিণের পাল, টাইগার পয়েন্ট, ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ বন, সুন্দরী গাছ ও গোলপাতার গাছ সহ সব কিছুই উপভোগ করলাম। কটকা ভ্রমন শেষে লঞ্চে ফিরে খিচুড়ি আর ডিমের কোর্মা দিয়ে সকালের নাস্তা সারতে সারতে দুবলারচরের উদ্দেম্যে রওনা দিলাম। আর পথে ছয় ঘন্টার ভ্রমনে সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে লাগলাম। পথে বড় বড় বক, স্বারষ, মদনটাক, চিল সহ অসংখ্য পাখির দেখা মিলল। চলতি পথে নদীতে দেখা মেলে ডলফিনের লাফঝাঁপ। কোকিল চর, তিন কোনার চর সহ অসংখ্য স্পট দেখতে মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল।

সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে এর নিকটবর্তী অবস্থানে থাকা বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। চলার পথে দেখা যায় অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা, নৌকায় থাকা জেলে, জ¦ালানি কাঠ সংগ্রহকারী, মৌয়াল। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা নৌপথ ভ্রমনের পর বিকাল সাড়ে তিনটায় আমরা পৌছালাম দুবলারচর। দুবলারচর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দুবলারচর। এটি হিরণ পয়েন্টের দক্ষিন-পূর্বে কুঙ্গা ও পশুর নদীর মাঝে অবস্থিত একটি দ্বীপ বা চর, যা হিন্দুধর্মের পূণ্য¯œান, রাসমেলা এবং মৌসুমী জেলেদের অস্থায়ী আবাসস্থল ও শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বহুল পরিচিত। তার চেয়ে বেশি ভাল লাগল রাশমেলা স্থলে যাওয়ার পথে দুবলারচরের সূর্যাস্তের ছবি। এখানে লাল বুক মাছরাঙ্গা, মদনটাক পাখি ও হরিণের দেখা মেলে।

দুবলারচরের জেলেদের মৌসুমী আবাসস্থল অর্থাৎ গোল পাতার ঘর ও ঘরের সামনে শুঁটকি শুকানোর মাচা দেখতে চমৎকার লাগছিলো। অনেকে আবার পুরো পরিবার নিয়ে আসে। এখানে তারা চার থেকে পাঁচ মাস থাকে। এই জেলেরা বেশিরভাগই দাদনদারদের নিকট দায়বন্ধ। আমাদের অনেকেই জেলেদের কাছ থেকে শুঁটকি কিনেছে। দামও অনেক কম। বিকালে সবাই মিলে রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত মেলায় ঘুরেছি। দেশি বিদেশী অসংখ্য পর্যটক ও সনাতন ধর্মের পূর্ণার্থীদের সমাগমে ভরপুর ছিলো মেলাস্থল। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনী ও বনবিভাগের নিরাপত্তা কর্মীরা নিয়োজিত ছিলো। মেলায় যাওয়ার পথে পথে পূর্ণার্থীরা বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্ন সামগ্রী প্রসাদ হিসেবে দর্শনার্থীদের মাঝে বিলি করছিলো। এই প্রসাদ নাকি ফিরিয়ে দেয়া বা না নেয়ার কোনো নিয়ম নেই, তাই আমাদের একেকজনের হাতে অনেক প্রসাদ জমে গেছে। পূর্ণার্থীদের কাছ থেকে জেনেছি, প্রতি বছর কার্তিক মাসে রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ্য করে দুবলার চরে এই রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর অসংখ্য পূর্ণাথী এখানে সমুদ্র¯œান করতে আসেন। পূর্ণার্থীরা ভোরে সুর্যোদয়ের আগে ¯œান করেন পাপমুক্তির আশায়। দুবলার চরে সুর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ।

রাতের বেলায় লঞ্চ চলে এলো হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে। খুলনা থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এই কেন্দ্রে অবস্থান। হাড়বাড়িয়া খালের পাড়ে ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রের সোনাালি নামফলক। একটু সামনে এগুলোই বন কার্যালয়। এরপরে ছোট খালের উপরে একটি ঝুলন্ত সেতু। সামনের দিকে জঙ্গলের গভীরতা ক্রমশ বেড়েছে। ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে সামান্য সামনে খননকৃত মিঠা পানির বিশাল একটি পুকুর। পুকুরে শাপলা শালুক ফুটে রয়েছে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিলো। পুকুরের মাঝে গোলপাতার ছাউনি সমেত একটি বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগারটির চারপাশে বসার জন্য বেঞ্চ পাতা। পুকুরের পার থেকে কাঠের তৈরি সেতু গিয়ে ঠেকেছে ঘরটিতে। হাড়বাড়িয়ায় সুন্দরবনের বিরল মায়া হরিণেরও দেখা মেলে। এখানকার ছোট ছোট খালগুলোতে আছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙ্গাসহ নানা জাতের পাখি। হাড়বাড়িয়ার খালে পৃথিবীর বিপন্ন মাস্ক ফিনফুট বা কালোমুখ প্যারা পাখিও দেখা যায়। এখানেও বাঘ ও বন দেখার জন্য রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। অবশেষে বাঘ মামার দেখা না পেলেও হাড়বাড়িয়ায় এসে দেখা পেলাম বাঘের পায়ের ছাপ। সেখানকার বনরক্ষীরা জানালেন তিনদিন আগে সেখানে বাঘ এসেছিলো। পুরো জঙ্গলটি খুবই মনোমুগদ্ধকর ও রোমাঞ্চকর।

হাড়বাড়িয়া থেকে দুপুরের আগেই চাঁদপাই জেলেপাড়া পাড়ি দিয়ে চলে এলাম সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত করমজল পর্যটন কেন্দ্র। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ৩০০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, বানর সহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। পাশাপাশি দেখা মিলল বাঘের কঙ্কাল বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলে বিকেলে করমজল এলাকায় দল বেধে বন্য চিত্রল হরিণের আগমন এবং পর্যটকদের হাত থেকে খাবার গ্রহন। এখানকার বানরগুলো সুযোগ পেলে মানুষের মাথার ক্যাপ, হাতের মোবাইল, ক্যামেরা নিয়ে যায়। তাই সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হয়। করমজল গিয়ে পর্যটকগন সহজেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ইকোসিষ্টেম সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর সাথে পরিচিত হতে পারেন। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল, টাওয়ার এবং জেলেদের মাছ ধরার কর্মজজ্ঞ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রাপ্তি। করমজলে বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র অবস্থিত। একদিনের ভ্রমণে যারা সুন্দরবন দেখতে চান তাদের জন্য আদর্শ জায়গা করমজল পর্যটন কেন্দ্র।

করমজল ভ্রমন শেষে করে মংলা পোর্ট, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নৌ ঘাটি ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পশুর নদীর তীর দেখতে দেখতে বিকাল চারটায় খুলনা শহরের রূপসা নদীর ঘাটে এসে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমন শেষ করলাম। জয় করলাম অনিন্দ্য সুন্দর, অপরূপ ও বিশে^র সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
প্রাবন্ধিক