হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রজনী কদরের রাত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’ (সুরা: কদর, আয়াত- ৩ )। ইমাম তাবারী (রহ:) তার তাফসিরে তাবারিতে উল্লেখ করেন, ‘লাইলাতুল কদরের আমল হাজার মাসের আমলের চেয়েও উত্তম যার মধ্যে অন্য কোন কদরের রাত নেই’(তাফসিরে তাবারি )। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশকের রাতগুলোর মধ্যে কোনো এক বিজোড় রাত হলো ভাগ্য নির্ধারণ বা লাইলাতুল কদরের রাত। শবে কদর উম্মতে মুহাম্মাদির শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহর প্রেমে সিক্ত হওয়া, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত অর্জনের এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে এ রাতে। ‘শবে কদর’ শব্দটি ফারসি। শব অর্থ রাত বা রজনী আর কদর অর্থ মহিমান্বিত, সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। শবে কদরের মোট অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদরের আরবি হলো লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। যে রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, সে রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ জিবরাইল (আ:)-সহ সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত ( সুরা: কদর,আয়াত- ১:৫)। রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। শবে কদর কোরআন নাজিলের রাত। এ রাতেই প্রথম মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ:)-এর মাধ্যমে রাসুলে পাক (সা:)-এর প্রতি কোরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারি ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে’ (সুরা: বাকারা,আয়াত- ১৮৫)।

শবে-কদর এমন এক রাত, যে রাতে সৃষ্টজীবের পূর্ণ এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেক প্রাণির রিযিক, জীবিকাসহ সর্বপ্রকার কাজ-কর্ম নির্ধারণ করা হয় বলে এই রাতকে লাইলাতুল কদর বা পরিমাপ নির্ধারণী রাত বলা হয়। রাসুল (সা:)-এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’ (বুখারি ও মুসলিম)। এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর নূর বর্ষিত হয়। ফেরেশতাগণ এবং জিবরাঈল (আ:) এ রাতে যমীনে অবতরণ করেন। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)। মহিমান্বিত এ রজনীটি রাব্বে কারিম সমস্ত কুমন্ত্রনা, শয়তানি ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্ত রেখেছেন, অকেজো রেখেছেন শয়তানের সমস্ত কাজকে। উবাই ইবনে কা’ব (রা:) বলেন, ‘শয়তান এ রাতে কাউকে ক্ষতি বা রুগ্ন করতে পারে ন, অথবা কোন বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে না এবং কোন যাদুকর তার যাদু কার্যকর করতে পারে না’। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন’। আবার কারো কারো মতে, ‘আল্লাহ তায়ালা এ বছরে যে সকল বিষয়ে নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন’। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহকারে ও সওয়াবের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে (রাত্রি জাগরত করবে), তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’( বুখারি শরীফ)। আবু বকর (রা:) ও আবব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এই তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, বিশ্লেষণের মাধ্যামে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (২৬ রমজানের রাতে) শবে কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসুল (সা:) এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি; বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন। রাব্বে কারিম তার প্রিয় বান্দাদের পরিচয় এভাবেই দিয়েছেন- ‘তারা রাত্রি যাপন করে রবের উদ্দেশে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে’ (সূরা: ফুরকান,আয়াত- ৬৪)।

মহিমান্বিত এ রাতকে আল্লাহ রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লুকিয়ে রেখেছেন। বান্দাহ বিনিদ্র্র রজনী কাটাবে, সবর করবে এর মধ্যে খুঁজে পাবে সম্মানিত রাত, পাবে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত; ফেরেশতার অদৃশ্য মোলাকাতে সিক্ত হবে তার হৃদয়, আপন রবের ভালোবাসায় হবে সে উদ্বেলিত। এ যেন দীর্ঘ বিরহের পর আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। এ দীর্ঘ প্রতিক্ষার কষ্ট-বিরহের মাধ্যমে রব তার বান্দাহকে আরো আপন করে নেন। কাজেই শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে হবে। প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল কদর মনে করতে হবে। তা হলে লাইলাতুল কদর হাতছাড়া হবে না। আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। ‘তাদের পার্শ দেশ বিছানা থেকে পৃথক থাকে (তারা শয্যা গ্রহণ করে না ; ও ইবাদতে মশগুল থাকেন)। তারা দোযখের ভয়ে এবং রহমতের আশায় তাদের প্রভুকে ডাকতে থাকে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করে থাকে। কেউ জানে না। তাদের আমালের পুরস্কারস্বরূপ (আখিরাতে) তাদের জন্য কী জিনিস গোপনে রাখা হয়েছে’ (সূরা: সিজদা, আয়াত- ১৬:১৭)। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা জীবনই এভাবে কাটান। আবু হুরায়রা (রা:)- হতে বর্ণিত- রাসুল (সা:)-এরশাদ করেন- ‘স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রমজানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর’ (মুসলিম শরীফ)। রাসুল (সা:) এরশাদ করেন- ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে অনুসন্ধান করো। (মুসলিম শরীফ)। রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই ( অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ শে রোজার দিবাগত রাত ) হলো শেষ দশকের বেজোড় রাত। রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতের মধ্যে কোনো একদিন লাইলাতুল কদর। তবে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায় আবহাওয়া বা ঝলমলে একটি প্রাশান্তির রাত হবে সেদিন। এই রাতটি হবে খুবই শান্ত ও শান্তিময়। এই রাত শেষে সকালটি হবে প্রশান্তির। এ রাতে প্রত্যেক বস্তুকে সেজদারত অবস্থায় দেখা যাবে। প্রতিটি স্থান হবে বেহেস্তী আলোয় আলোকিত। সবচেয়ে সুস্পষ্ট নিদর্শন হচ্ছে, এই রাতের ইবাদত অন্তরে তৃপ্তি জোগাবে। এটি দোয়া কবুলের রাত। আমাদের ভাগ্য বা মহিমান্বিত রজনী। এই রাতেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। আয়েশা (রা:) রাসুল (সা:)-কে জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসুল! (সা:)- আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুল (সা:) বলেন; তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন’ (ইবনে মাযাহ)।

শবে কদরের আমল সমূহ : নফল নামাজ, তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল পড়া। নামাজে কিরাত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। কোরআন তিলাওয়াত করা। দরুদ বেশি বেশি পড়া, কারণ দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা। দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার করা। কবর জিয়ারত করা। নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। দোয়ার মাধ্যমে বান্দাহর বন্দেগি ও আল্লাহর রবুবিয়াতের প্রকাশ ঘটে। বান্দাহ তার প্রভুর কাছে চায়। আল্লাহ এতে ভীষণ খুশি হন। আল্লাহ তার বান্দার প্রতি এতটাই অনুগ্রহশীল যে, তিনি তার কাছে না চাইলে অসস্তুষ্ট হন। ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন’ (তিরমিজি)। রাসুল (সা:)- এরশাদ করেন- ‘তোমাদের পরওয়ারদিগার লজ্জাশীল ও দাতা; লজ্জাবোধ করেন যখন তাঁর বান্দাহ তার কাছে দুই হাত ওঠায়, তখন তা খালি ফিরিয়ে দিতে’ (তিরমিজি, আবু দাউদ, বায়হাকি)। আয় রাব্বে কারিম তোমার দরবারে গোজারিশ আমাদের এ রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক