বেকারত্ব বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। বেকারত্বের হার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতির জন্য বেকারত্ব মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কর্মহীন বিশাল উদ্বৃত্ত জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে পারছে না কোনো অবদান রাখতে, পারছে না সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত তৈরী করতে। বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। দেশে সর্বত্রে দেখা দিচ্ছে বিশৃংখলা। বেকারত্বের সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত জরিপে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জরিপে জাতীয় বেকারত্বের গড় হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। অর্থাৎ বেকারত্বের ১১ দশমিক ২ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের জরিপ অনুসারে দেশে ২৬ লাখ বেকার ছিল। তন্মধ্যে পুরুষ সংখ্যা ১৪ লাখ, নারীদের সংখ্যা ১২ লাখ। আইএলওর প্রতিবেদন ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দাড়াবে ৩০ লাখ হতে বেশি। আইএলওর তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেকারত্বের হার কম ছিল ২০১০ সালে। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। ২০১২ সালে ছিল ২৪ লাখ। ২০১৬ সালে ২৮ লাখে উঠেছে। ২০১৯ সালে ৩০ লাখে ওঠার আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এদিকে নতুন করে চাকরিহারা হচ্ছেন অনেক শ্রমিক। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত হলেও বেকারত্বের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারত্বের সংখ্যা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, এবং কমনওয়েলথসহ একাধিক সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২ শতাংশ। শিক্ষিতের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্ব বাড়ার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ২৭ লাখ, চাকরি পাচ্ছে ১ লাখ ৮৯ হাজার। শুধু মাত্র তা ৭ শতাংশ। আইএলওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার, কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। বেকারের মধ্যে আংশিক বা পার্ট টাইম বেকারের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের তথ্য মতে, গত ছয় মাসে শিল্প খাত থেকেই প্রায় ১০ লাখ লোক কাজ হারিয়েছে। নির্মাণ খাত, কৃষি খাত, পোলট্রি এবং সেবা খাতেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব । অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতক পাশ বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেশি। শিক্ষিত তরুণেরা দেশের বোঝা নয়, মূলত দেশের সম্পদ! বেকার নারী-পুরুষ হন্যে হয়ে কাজ অনুসন্ধান করছেন, কিন্তু তারা পাচ্ছেন না। পিতা-মাতা হয়তো পড়াশোনা শেষ করা ছেলে বা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে আছে, কখন তারা পরিবারে সচ্ছলতা বয়ে আনবে ও তাদের মুখে হাসি ফুটাবে।

বেকারের নীরব কষ্ট-যন্ত্রণা কেউ অনুভব করতে পারে না, কেউ বোঝে না বা বোঝতে পারে না তাদের মনের অনুভূতি লোকানো কষ্ট-যন্ত্রনা। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেশনজট, জরাজর্ণী শিক্ষাব্যবস্থা ও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে দিন দিন বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। ইউনেস্কোর এক গভেষণা মতে, শিক্ষা হলো দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান শর্ত। আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তা কি শিক্ষিত জাতির কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করতে ভূমিকা রাখছে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন। একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তরধারী কিংবা শিক্ষিত তরুণ তার পড়ালেখা শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া আর উপায় কী? এদেশে একজন তরুণের উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকাত্বের যন্ত্রণা মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছে। দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে কাজের আশায় দুবেলা-দুমুঠো ভাতের জন্য এদেশের তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন উন্নত দেশে যাত্রাপথে জীবন বিপন্ন হচ্ছে, পৌঁছাতে পারলেও নানা সমস্যার কারণে লুকিয়ে মানবেতর জীবন পার করছেন। দেশের শিক্ষিত তরুণ ও তরুণী কাজ পাচ্ছে না অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলেতে দেখা যায় বিদেশ থেকে উঁচু বেতন দিয়ে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন। অথচ আমরা যোগ্য লোকবল তৈরি করতে অপারগ। শিক্ষিত তরুণদের মেধা ও শ্রমশক্তি যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। তাহলে বেকারত্বের বোঝা কিছুটা লাগুভ হবে।

তরুণেরা কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকে মাদকসহ নেশা জাতিয় নানাবিধ অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বেকার তরুণ ও তরুণীদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। সরকারি যে সকল শূন্য পদগুলো রয়েছে, এসব শূন্যপদ পূরণের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। দেশে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের প্রায় কাছাকাছি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ শিক্ষিত বেকার শ্রমবাজারে আসছে। যার মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ চাকরি পেলেও প্রায় ৫৫ শতাংশ বেকার অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি পাচ্ছে না।

দেশের শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা তৈরিতে বা বিদেশে কাজের জন্য প্রস্তুত করতে উন্নত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতায় সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বেকারত্ব দেশের অভিশাপ নয় বরং তারাও সুযোগ পেলে দেশ ও পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়। নীতি-নির্ধারকদের কাছে সেই সুযোগ তৈরি করার একমাত্র আশ্রয়স্থল। তা না হলে বড় ধরনের জনশক্তি বিপথগামী হবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি। শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান যদি তৈরী করে না দেয়া হয়, তাহলে সেটি দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ে তুলতে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।