– [ ] ‘শমসের গাজী’ বইটি মূলতঃ ইতিহাসের বই। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় এটি বাংলাদেশের জন ইতিহাসের বই। কয়েক বছর আগে ফেনীতে বেড়াতে গিয়ে শমসের গাজী দিঘী’র সামনে বেশ কিছুক্ষণ বসে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ হয় আমার, সেই সাথে ‘ভাঁটির বাঘ’ হিসেবে পরিচিত শমসের গাজী সম্পর্কেও লোকমুখে কিছুটা শুনেছি। তাঁকে কেউ কেউ পরিচয় করে দিয়েছেন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা হিসেবে, কেউ কেউ বলেছেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। তবে স্থানীয়দের প্রায় সবাই জানিয়েছিলেন সেই এলাকায় সুপেয় পানির অভাব দূর করার জন্যই শমসের গাজী বেশ কিছু দিঘী খনন করেছিলেন। পরবর্তীতে ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগণার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক হিসেবেও শমসের গাজীর পরিচয় পাই। তখন থেকেই মনে মনে শমসের গাজী সম্পর্কে একধরনের আগ্রহ জেগে ওঠে মনে। রোজার ঈদের পরদিন মানে ১৫.০৬.২১ তারিখে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই বইটি হাতে পাই স্বয়ং লেখক ডঃ গাজী সালেহ উদ্দিন স্যারের হাত থেকে। বইটি পড়তে গিয়ে জানতে পারি লেখক দীর্ঘ পাঁচ বছর নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে রচনা করেন এই বইটি। তথ্যের উৎস হিসেবে শমসের গাজী সম্পর্কে লিখিত বিভিন্ন রচনাবলীর বাইরে আগরতলা কলকাতা, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীতে প্রাপ্ত বিভিন্ন গ্যাজেট এবং ভূমি অফিসে রক্ষিত নানা দলিল দস্তাবেজও কাজে লাগান। নিঃসন্দেহে এটা খুব কষ্টকর কাজ কিন্তু এইসব কষ্টকর ঘাটাঘাটির মাধ্যমে বের করে আনেন অনেক অজানা তথ্য যা এতোদিন জানা ছিলোনা কারোই! এধরনের জন ইতিহাস রচনা করতে গেলে প্রায়শই নির্ভর করতে হয় কিছু অনুমানের উপর এবং নিজেদের কল্পনা শক্তিকেও কাজে লাগাতে হয় বেশ। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকের কারো সম্পর্কে ইতিহাস ভিত্তিক বই রচনা করা সত্যিই বেশ দূরহ।ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্বে এই ধরনের জন-ইতিহাস প্রচুর পরিমানে লিপিবদ্ধ থাকায় সেখানে তথ্য উপাত্ত পেতে এতোটা বেগ পেতে হয়না, সেখানে অষ্টাদশ শতককে মনে হতে পারে বেশ নিকট অতীত! এই অসুবিধা দূর করার জন্য হলেও এই অঞ্চলে সঠিক তথ্যভিত্তিক গবেষণাধর্মী, জন ইতিহাস আরো বেশি রচিত হওয়া উচিত। ডঃ গাজী সালেহ উদ্দিন এই বই লিখতে গিয়ে তথ্যানুসন্ধানে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সোর্স এবং প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি তথ্য নিয়েছেন সেখ মনুহর রচিত মহাকাব্য ‘গাজীনামা’ থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তথ্যানুসন্ধানে নানা ধরনের তথ্য এমনকি বিপরীতমুখী তথ্যও বের হয়ে আসে, এইসব নানা তথ্যের সম্ভার থেকে প্রকৃত সত্যকে (প্রকৃত সত্য বলে যদি কিছু থাকে!) বের করে আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বটে। সেই চ্যালেঞ্জ পুরোটা উতরে গেছেন লেখক সেটা বলা মনে হয় সমীচীন হবেনা, তবে তিনি কল্পনা এবং ভাবালুতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দালিলিক প্রমানের প্রতি জোর দিয়েছেন বেশি।

– [ ] ‘শমসের গাজী’ রচনাটি একদিকে বাংলাদেশের জন ইতিহাস এবং এই অঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে কৃষক শ্রেনীয় মানুষদের শেকড় সন্ধানী অন্যদিকে ডঃ গাজী সালেহ উদ্দিন খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত শেকড়ের সন্ধানও! পরিশিষ্ট অংশে দেখানো বংশলতা থেকে জানা যায় ডঃ গাজী সালেহ উদ্দিন শমসের গাজীর সপ্তম বংশধর এবং তাঁর পুত্র সালেহীন তানভীর গাজী, শমসের গাজীর অষ্টম বংশধর। ‘শমসের গাজী’ রচনার একটি দূর্বল দিক হচ্ছে, ডঃ গাজী সালেহ উদ্দিন ‘শমসের গাজী’ এই ঐতিহাসিক চরিত্রটিকে অংকন করেছেন এক বিশেষ মমতায় (এ অবশ্য আমার একান্ত উপলব্ধি )। এটা সত্যি, তিনি প্রকৃত তথ্যানুসন্ধানে বেশ সচেষ্ট ছিলেন কিন্তু এধরনের ঐতিহাসিক বই রচনার ক্ষেত্রে যতোটা নিরপেক্ষতা এবং নির্মোহ ভাবের প্রয়োজন হয় সেখানে কিছুটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। জানিনা, সেই ঘাটতি এই কারনে কিনা যে শমসের গাজী ছিলেন তাঁরই সপ্তম পূর্বপুরুষ ।

– [ ] শমসের গাজীর ডাকাত সর্দাররুপে আবির্ভাবকে লেখক নেতিবাচক হিসেবে না দেখে অনেকটা বীরোচিত ভাবেই উপস্থাপন করেছেন এবং এর পেছনে তিনি যুক্তিও দেখান যা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতন নয় এবং এটাও মিথ্যা নয় যে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার জন্য তা প্রয়োজনও ছিল বইকি। শমসের গাজী যে চারটি বিয়ে করেন তার মধ্যে চতুর্থ বিয়ে করেন জোরপূর্বক তার কর্মচারীর বিবাহিত কন্যা শিখা রানীকে। এই বলপূর্বক বিয়েকেও লেখক কিছুটা পক্ষপাতমূলক মমতায় অংকন করেছেন। সর্বশেষ, লেখক যে বংশলতার মাধ্যমে শমসের গাজীর স্ত্রী হিসেবে দৈআ বিবিকে উপস্থাপন করেছেন এবং দৈআ বিবির পুত্র সোয়াগাজী/সুয়াগাজীর মাধ্যমে সপ্তম বংশধর হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন তা বেশ চমকপ্রদ এবং এক নতুন দিগন্ত উন্মোচক কিন্তু তথাপি তা একেবারে নিঃসন্দেহে মেনে নেওয়ার মতন যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। লেখকের ভাষায়-ই তা দেখে নেয়া যাক। লেখক বইয়ের ১৫৬-১৫৭তম পৃষ্ঠায় দৈআ বিবির রহস্য উন্মোচনে প্রয়াসী হয়ে লিখেনঃ “প্রশ্ন আসে পরবর্তী সময় দৈআ বিবির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কেন? সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়, যেহেতু শমসের গাজী তাকে জোর করে বিবাহ করেছেন এবং তার বাবা ভাইয়ের হত্যা করে জমিদারি কেড়ে নিয়েছেন তাই তাদের বৈবাহিক পারস্পরিক দাম্পত্য জীবন সম্পর্ক ভালো থাকার কথা নয়। দ্বিতীয়তঃ শমসের গাজী দৈআ বিবিকে তার পিতার জমিদারিতে রাখতে চাইবেন না, কারণ জমিদার নাসির মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার যে সব লোকজন ছিল তার মধ্যে অনেকেই শমসের গাজীর বশ্যতা স্বীকার বা কাজে যোগ দিয়েছিল তাই দৈআ বিবিকে অন্য কোথায়ও থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া শ্রেয় ও যৌক্তিক। সেই যুক্তি থেকে আমরা বলতে পারি শমসের গাজী তারই জমিদারি রোসনা চাকলাবাদে প্রাচীন চন্দ্রপুর গ্রাম বর্তমান পূর্ব বটগ্রামে দৈআ বিবিকে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে দেন এবং দৈআ বিবির ঔরসে শমসের গাজীর প্রথম পুত্র সন্তান সুয়াগাজী জন্মগ্রহণ করেন।” উক্ত অংশে পূর্ব চন্দ্রপুর গ্রামে এবং বর্তমান পূর্ব বটগ্রামে দৈআ বিবিকে স্থাপন কিছুটা অনুমান নির্ভর মনে হয়েছে অবশ্য লেখকের হাতে এরচেয়ে বেশি দলিল না থাকায় কিছুটা যৌক্তিক অনুমান না করেও উপায় ছিলোনা।

– [ ] সব মিলিয়ে ডঃ গাজী সালেহউদ্দিন রচিত বাংলাদেশের জন-ইতিহাস গ্রন্থমালা সিরিজের ‘শমসের গাজী’ বইটি আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং আমাদেরকে আমাদের শেকড়ের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। প্রসঙ্গক্রমে মার্কাস গার্ভে’র একটি কথা মনে পড়লো, তিনি বলেছেন-‘যে ব্যক্তি নিজের ইতিহাস, উৎপত্তি ও সংস্কৃতি জানেনা সে একটি গাছের মত যে তার শেকড় চেনে না।’ ‘শমসের গাজী’ আমাদেরকে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আপন শেকড় সম্পর্কে সচেতন করবে এবং নিজেদের শেকড় সন্ধানে অনুপ্রানিত করবে। বইটি বহুল পঠিত হলে সামগ্রিকভাবে আমরাই উপকৃত হবো। বাংলাদেশের জন-ইতিহাস গ্রন্থমালা প্রকাশে ‘সময় প্রকাশন’ এগিয়ে আসায় এই সুযোগে তাদেরকেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

– [ ] শফিউল আজম মাহফুজ, কবি ও প্রাবন্ধিক।