চীনের সিনোফার্ম এবং স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে কোভিড-১৯ এর টিকা উৎপাদনে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এবং ইনসেপ্টার চেয়ারম্যান আবদুল মুক্তাদির সমঝোতা স্মারকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সই করেন। সোমবার (১৬ আগস্ট) বিকেল ৫টায় রাজধানীর মহাখালীর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন (বিসিপিএস) মিলনায়তনে এ চুক্তি সই হয়। এই চুক্তির আওতায় ইনসেপ্টা টিকা উৎপাদনের কাচাঁমাল থেকে শুরু করে বোতলজাতকরণ এবং লেবেলিং করবে। ফলে টিকার মূল্য তুলনামূলকভাবে কম হবে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে চুক্তি অনুযায়ী, স্থানীয় এই ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিটি শিগগিরই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে টিকা উৎপাদনের জন্য সোমবার (১৬ আগস্ট) চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় চীনের সিনোফার্মের এ টিকা দেশীয় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে উৎপাদন করা (ফিল ফিনিশড) হবে। শুধু বেসরকারি পর্যায়েই নয়, সরকারিভাবেও করোনার টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিদেশেও টিকা রপ্তানি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। এ চুক্তির মাধ্যমে একটি স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। দেশে টিকার উৎপাদন শুরু হলে দেশের মানুষকে বেশি বেশি টিকা দেয়া যাবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যাবে। দেশের অর্থনীতি আরও সচল হবে। করোনা রোগীদের চিকিৎসাদানে স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ কমবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনার শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ ও গাইডেন্স দিয়ে যাচ্ছেন। ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসামগ্রীসহ যখন যেটা প্রয়োজন সেটা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ এমনকি করোনা প্রতিষেধক টিকা তৈরির স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ চুক্তি প্রধানমন্ত্রীর কারণেই সম্ভব হচ্ছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট তিন কোটি ১০ লাখ ভ্যাকসিন পেয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ডোজের এক কোটি ৫৪ লাখ ও দ্বিতীয় ডোজের ৫৪ লাখসহ মোট দুই কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে হাতে আরও এক কোটি ডোজ টিকা মজুত রয়েছে। আগামী ২০-২২ আগস্টের মধ্যে আরও ৫০ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা আসবে। সিনোফার্ম থেকে কোভ্যাক্স ও উপহারসহ মোট এক কোটি ৩৫ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছি বলে জানান তিনি।

‘কোভ্যাক্সসহ বিভিন্ন দেশ যেমন- চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টিকাপ্রাপ্তির ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে ছয় কোটি ডোজ টিকার চুক্তি হয়েছে। ফলে আমরা এখন থেকে টিকা পেতেই থাকব’- যোগ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ১৩ কোটি মানুষকে ২৬ কোটি ডোজ টিকা দিতে হবে, তাই অনেক টিকা দরকার। আজ চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে এ চুক্তির ফলে দেশে ইনসেপ্টার মাধ্যমে টিকার উৎপাদন হবে। তাদের স্থাপনাও রয়েছে, আরও কিছু যদি প্রয়োজন হয় তা সম্পন্ন করে খুব শিগগিরই দেশেই সিনোফার্মের টিকার (ফিল ফিনিশড) উৎপাদন হবে।

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, দেশে আর টিকার সমস্যা হবে না। দেশেই টিকার উৎপাদন হবে। সরকার বিদেশ থেকে অনেক টাকা খরচ করে টিকা কেনে। প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে সবাই বিনা পয়সায় টিকা পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, করোনার টিকা হলো সংক্রমণ রোধের একটি পদ্ধতি। সবচেয়ে বড় পদ্ধতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তিনি দেশের মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য কোভিড ভ্যাকসিনের তুলনায় সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং এটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের বিতরণের ক্ষেত্রে সহজ হবে।

এর আগে শুক্রবার, চীন থেকে বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ডোজ এসেছে। এটি ছিল সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের তৃতীয় চালান যা চীন বাংলাদেশে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। আগের শিপমেন্টে চীন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল ৫ লাখ ডোজ যা গত ১২ মে এবং গত ২১ মে এসেছিল ৬ লাখ ডোজ টিকা।

বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিনের ১৫ মিলিয়ন ডোজের জন্য চীনকে অর্থ প্রদান করেছে। যার মধ্যে সাত মিলিয়ন ডোজ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। গত ১১ আগস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিনোফার্ম থেকে কোভিড ভ্যাকসিনের ৬০ মিলিয়ন ডোজ কেনার বিষয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। কোভ্যাক্স সুবিধার অধীনে বাংলাদেশ একই ভ্যাকসিনের ১১ লাখ ডোজ পেয়েছে। দেশে বর্তমানে চারটি কোম্পানি- অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না এবং সিনোফার্মের তৈরি ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।

দেশে এ পর্যন্ত সিনোফার্মের ভ্যাকসিন এসেছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার ডোজ। আর চারটি ব্র্যান্ডের সব মিলে এসেছে ৩ কোটি ২০ লাখ ১৭ হাজার ৯২০ ডোজ। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন এসেছে চীন থেকে।