ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান তারা। তারা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। এদের অনেকে মালয়েশিয়া থেকে কেউ লন্ডন আবার অনেকে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন। তাদের কেউ নিজে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবার কেউ শিল্পপতির সন্তান। আর এখন তারা জড়িয়েছেন ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের ব্যবসায়। সর্বনাশা এই মাদক সেবনও করতেন তারা। এই চক্রটির ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার পর প্রায় এক মাস ধরে চেষ্টা চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। অবশেষে শুক্রবার বিকেল থেকে শনিবার পর্যন্ত রাজধানীর বনানী, উত্তরা, বনশ্রী ও খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নিবার (২১ আগস্ট) দুপুরে তেজগাঁও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্টো উত্তর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্টোর অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান এসব তথ্য জানান।

ফজলুর রহমান বলেন, ‘একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্টোর গোয়েন্দা দল মাঠে নামে। তদন্তে একটি শক্তিশালী আইস নেটওয়ার্কের সন্ধান পায় এবং শনাক্ত করে। ২০ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ২১ আগস্ট ভোর ৬টা পর্যন্ত ৫টি টিম অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুই নারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।’

গ্রেপ্তাররা হলেন- রুবায়াত (৩২) রোহিত হোসেন (২৭), মাসুম হান্নান (৪৯), আমান উল্লাহ (৩০), মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান (২৯), মুসা উইল বাবর (৩৯), সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান (৩০), লায়লা আফরোজ প্রিয়া (২৬), তানজীম আলী শাহ (৩২) ও হাসিবুল ইসলাম (২২)।

অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, ‘প্রথমে বনানীতে বাবরের বাসায় অভিযান চালিয়ে বাবর, রুবায়াত ও রোহিত হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরা, খিলগাঁও, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও রামপুরা থেকে বাকিদের গ্রেফতার করা হয়। আর ইভানের তথ্যের ভিত্তিতে ইয়াবার ডিলার অর্পিতা ও প্রিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, ‘সবেমাত্র গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের যথেষ্ট সময় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নিয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে এসব আইস আনা হয়েছে। তবে এরা কার কাছ থেকে আইস পেয়েছে, তাদের কাউকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’

‘আইস’ মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘ইয়াবার চেয়ে আইস ২০ গুণ এনার্জেটিক, ফাঁকি দেওয়া সহজ ও সামান্য আইসই লাখ লাখ ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল। তাই মাদক হিসেবে আইসের ব্যবহার বাড়ছে।’

জানতে চাইলে অভিযান পরিচালনাকারী সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, ‘রোহিত হোসেন মালয়েশিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। উত্তরায় একটি মার্কেটের মালিক তার বাবা। সে ইয়াবা সেবন করতো। একদিন শখের বসে আইস খায়। এরপর বন্ধু বান্ধবদের কাছে বিক্রি করতো এবং নিজেও আইস মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে ‘

রুবায়েত লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে এসে বাবার গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে রোহিতের মাধ্যমে আইস মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। বাবর মূলত হেরোইন সেবন করতো। এরপর আইস মাদকে আসক্ত হয়। বাবর পেশায় কিছু করে না। বাবার টাকায় জমিদারি করে। ইভানের পরিবার আছে। ব্যবসা করে। সংসারে স্ত্রী ও ৪০ দিনের এক সন্তান আছে। হাসিবুলের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি (৩০০ গ্রাম) আইস পাওয়া যায়।

গ্রেফতার তানজীম আলী শাহ ওরফে রাজ এই চক্রের মূলহোতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে ‘মানি হাইস্ট’ সিরিজ দেখে নিজেকে মাস্টারমাইন্ড মনে করতো। ওই সিনেমায় একজন প্রফেসর যেভাবে নিজেকে ‘ডাকাত সর্দার’ ভাবত একইভাবে রাজও নিজেকে গডফাদার মনে করতো। চক্রের অন্যরাও এভাবেই রাজকে সম্বোধন করতো। রাজের মাধ্যমেই হাসিবুরকে ধরা হয়।

মাসুম হান্নানকে ধরতে যাওয়ার পর তার মা ও বোন আমাদের জানিয়েছে, ‘একে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান। একে নিয়ে আর আমরা পারছি না।’

ইভানের তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে প্রিয়াকে এবং পরে অর্পিতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত দুই নারীর কাছে ইয়াবাগুলো পাওয়া যায়। ইভান প্রিয়ার কাছ থেকে ইয়াবা কিনত আর অর্পিতা ইভানের কাছ থেকে আইস কিনতো।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সুরীত সরকার নামে এক ব্যক্তিকে গত ৫ আগস্ট ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে আইস সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যা এর আগে কখনোই পাওয়া যায়নি। মূলত সুরীত সরকারের তথ্যের ভিত্তিতেই এই চক্রটির সন্ধানে নামে গোয়েন্দারা।

সূত্রটি জানায়, সুরীত সরকার দেশে আইস সরবরাহ করে থাকে। সুরীত সরকারের মতো বেশ কয়েকজন রয়েছেন। যারা আইস সরবরাহ করে থাকে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তাদের শনাক্তে কাজ করা হচ্ছে। মূলত সুরীত সরকার ও অন্যরা দেশে আইস সরবরাহকারীদের দ্বিতীয় স্টেজে কাজ করেন। আর যে চক্রটি গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা মূলত তৃতীয় স্টেজে কাজ করেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি আইস বেচাকেনায় দ্বিতীয় সারির কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আইস কারবারে জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে এই চক্র আইস আমদানি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে। গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আইসের ক্রেতা বাড়াতে তারা প্রথমে টার্গেট ব্যক্তিকে বিনামূল্যে সরবরাহ করেন। পরে তারা আসক্ত হন এবং নিয়মিত ক্রেতা বনে যান।