প্রিয় সিলেটে বারবার যেতে চেয়েছিলেন তিনি। এবার যাচ্ছেন, তবে সেটা কফিনে। শিশুর মতো সদা হাস্যোজ্জ্বল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কখনো সরকারের আমলা, কখনো বা রাজনীতিবিদ—সব ভূমিকাতেই সফল তিনি।

সব প্রাপ্তি শেষে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
সিলেট নগরের রায়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে আজ রবিবার আবুল মাল আবদুল মুহিতের (৮৮) দাফন সম্পন্ন হবে। তার আগে দুপুর ২টায় নগরের আলিয়া মাদরাসা মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

প্রয়াত মুহিতের ভাই ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “মুহিত ভাই অত্যন্ত সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তিনি অনেক দিন ধরেই বলছিলেন, ‘আমার প্রাপ্তি হয়েছে, আমার কাজ শেষ, তোমরা দেখো বাকিটুকু। ’ ইনফ্যাক্ট কয়েক দিন ধরেই তিনি বলছিলেন সিলেট চলে যাবেন। সপ্তাহ ধরে আল্লাহকে স্মরণ করছেন এবং চলে যাওয়ার জন্য স্থির হয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। আপনারা সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন। ”

গতকাল সফল এই মানুষটিকে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সকালে রাজধানীর গুলশানে প্রথম জানাজার পর দুপুরে তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে জাতীয় সংসদ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়।

গুলশানে প্রথম জানাজা : রাজধানীর গুলশানের আজাদ মসজিদে গতকাল সকাল ১১টার দিকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তাঁর বড় ছেলে সাহেদ মুহিত, ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও ডা. এ কে আব্দুল মুবিন জানাজায় অংশ নেন। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নরুল ইসলাম নাহিদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি, দলীয় নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা : প্রথম জানাজার পর আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে আবুল মাল আবদুল মুহিতের কফিনে রাষ্ট্রপতির পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবির আহমেদ ও স্পিকারের পক্ষে সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কমোডর এম নাইম রহমান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রয়াত আবদুল মুহিতের প্রতি আরো শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন সাবেক এই অর্থমন্ত্রীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ দেশের রাজনীতিতে সৎ মানুষ বেশি নেই, মুহিত সাহেব শতভাগ সৎ ছিলেন। আমি এ রকম কাজ পাগল মানুষ কমই দেখেছি। বন্ধের দিনও তাঁকে অফিসে দেখা যেত। জনগণের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব অর্থমন্ত্রী হিসেবে সফল ছিলেন। ’

হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মুহিতের মৃত্যুতে আমরা দেশের অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রাখা একজন বিজ্ঞ ও ভদ্র মানুষকে হারালাম। বাংলাদেশ যে আজ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, সব প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ যে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছেন। ’

রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা তাঁকে দেশের যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সব সময় কাছে পেয়েছি। তিনি ছিলেন জনগণমুখী। ’

হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বহু গুণে গুণান্বিত মুহিত ভাই। আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ থেকে একজন মেধাবী লোককে হারালাম, সাংস্কৃতিক জগতের একজন পৃষ্ঠপোষককে হারালাম, একজন বাস্তবভিত্তিক অর্থনীতিবিদকে হারালাম। ’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়াশিংটনে ছিলেন এবং প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

দাফন হবে সিলেটে : শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মুহিতের মরদেহ বনানীর বাসার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে দাফনের জন্য মরদেহ নেওয়া হয় তাঁর জন্মস্থান সিলেটে। আজ সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তাঁর মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে তাঁর মরদেহ। এরপর দুপুর ২টায় নগরের আলিয়া মাদরাসা মাঠে তাঁর জানাজা অনুুষ্ঠিত হবে। পরে রায়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে শেষশয্যায় শায়িত করা হবে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে।

দুই দিনের শোক : ভাষাসৈনিক, সফল আমলা, লেখক, রাজনীতিবিদ ও সাবেক জনপ্রতিনিধি আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুতে দুই দিনের শোক ঘোষণা করেছে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শমশের জামাল বলেন, ‘এই দুই দিন সিলেটে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও নেতাকর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। ঈদের পরের দিন সিলেটের সব মসজিদ, মন্দির, গির্জায় দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ’

আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধারে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক ও ভাষাসৈনিক ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।