নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রয়কৃত বিলাসবহুল ১০টি গাড়ি বিক্রি করে বিক্রয়কৃত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা-১ উপসচিব মো. ফরহাদ হোসেনের সই করা এক আদেশে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে; যার মধ্যে ১০টি গাড়ি শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এসব গাড়ি খোলা দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা খাতে ব্যয় করতে হবে। অন্য কোনো খাতে এই অর্থ ব্যবহার করা যাবে না। পুরো বিষয়টি নজরদারি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আইন অনুসারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ১২টি বিলাসবহুল গাড়ি নিজেদের ব্যবহারের জন্য কিনেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওজি) সদস্যরা। সেগুলো ব্যবহারও শুরু করেন তারা।

জানা যায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টবোর্ড সদস্যদের ব্যবহারের জন্য প্রথম বিলাসবহুল সাতটি গাড়ি কেনে ২০১৯ সালের জুনে। পরে আরও আরো পাঁচটি গাড়ি কেনা হয়। কেনা সবগুলো গাড়িই ল্যান্ড রোভারের রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের। গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন নম্বর হলো ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৮৩৬, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৮৪০, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৭৬২, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৭৬৩, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৫৭৮, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৪৪৬ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩৪৪৫।

বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় কেনা বিলাসবহুল এ গাড়িগুলো ব্যবহার করতেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ, সদস্য বেনজীর আহমেদ, এম এ কাশেম, রেহানা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান, ফৌজিয়া নাজ, ইয়াসমীন কামাল ও তানভীর হারুন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় কেনা দামি ও বিলাসবহুল এ গাড়ি বোর্ডগুলো বিওজি সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন। যদিও পরে বিতর্ক ওঠার পর সমালোচনার মুখে এসব গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিয়ে দেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ৯ সদস্য। প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এম এ হাসেম একটি গাড়ি ব্যবহার করলেও তার মৃত্যুর পর গাড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দেয়া হয়। এম এ হাসেমের মৃত্যুর পর তার ছেলে আজিজ আল কায়সার (টিটু) সদস্য হিসেবে যুক্ত হলেও তিনি কোনো ধরনের গাড়ি সুবিধা নেননি বলে জানা গেছে।

সমালোচনার মুখে সেই গাড়িগুলো ফেরত পাওয়ার পর বর্তমানে এনএসইউ ক্যাম্পাসের পার্কিংয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। সেগুলো এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পড়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ১২টি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে; যার মধ্যে ১০টি গাড়ি শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

আদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪(১) ধারা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাধারণ তহবিল থাকবে এবং আইনের ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ি সাধারণ তহবিলের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোন উদ্দ্যেশে ব্যয় করা যাবে না।

যে ১০টি গাড়ি বিক্রি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ভোগ পি ৪০০ ই, মডেল-২০১৯, হার্ড জিপ রেঞ্জ রোভার অটোবায়োগ্রাফি মডেল ২০১৯, কার সেলুন মার্সিডিজ বেঞ্জ মডেল ২০১৯, হার্ড জিপ (টয়োটা প্রাডো টি এপ), মডেল-২০১৫, হার্ড জিপ রেঞ্জ রোভার ভোগ পি ৪০০ই ২০১৯ মডেলের সব গাড়ি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়ার নির্দেশের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামের মুঠোফোনে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ল্যান্ড রোভারের রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের একেকটি গাড়ি ক্রয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গতকালের আদেশেও গাড়িগুলোর মূল্য তুলে ধরা হয়েছে।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় টাকায় কেনা গাড়ি ট্রাস্টবোর্ড সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। তারা জানান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যে ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তার চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, এ ট্রাস্ট মানবহিতৈষী, দানশীল, জনহিতকর, অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও অবাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় গাড়ি কেনা মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর বলেছিলেন, ‘এটা একটা আর্থিক স্বেচ্ছাচারিতা।বিশ্ববিদ্যালয় যত আয় করবে, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালিয়ে যা অতিরিক্ত থাকবে, সেটা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য উন্নয়নকাজ করা হবে। ট্রাস্টিদের জন্য গাড়ি কেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না।’