গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের ১১৯ জন নেতাকে শো’কজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে গত বছরের ১৯ নবেম্বর মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত এবং দল থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কারের পর তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এসব নেতাদের শো’কজ করা হয়। এতে দল থেকে বহিষ্কার আতংকে ভুগছেন দলের বেশকিছু নেতা-কর্মী।

জানাগেছে, দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের ১১৯ জন নেতাকে শো’কজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গত ১ জুন (বুধবার) মহানগর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতাউল্যাহ মন্ডল স্বাক্ষরিত এ শো’কজ নোটিশের চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে আগামি সাত দিনের মধ্যে শো’কজের জবাব দিতে বলা হয়েছে। শোকজ প্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে ১৯ জন গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে রয়েছেন। অপর এক’শ জন নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের কমিটিতে থাকা নেতা-কর্মী।

শোকজ’র চিঠি প্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ নয়ন, সহ-সভাপতি ও গাজীপুর আদালতের জিপি আমজাদ হোসেন বাবুল, যুগ্ম সম্পাদক ও গাজীপুর জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান এসএম মোকছেদ আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ রফিকুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক এডভোকেট মনির হোসেন মিয়া, সহ-দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল আলম, ক্রীড়া সম্পাদক আসাদুজ্জামান তরুন, সদস্য সিটি কাউন্সিলর আজিজুর রহমান শিরিষ, সদস্য রজব আলী, সদস্য হাজী আব্দুর রশিদ প্রমুখ রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড কমিটির একশত নেতা রয়েছেন।

এদিকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ও কাউন্সিলরদের মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হবে। সে হিসেবে আগামি বছর মে অথবা জুন মাসের মধ্যেই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের আগামী নির্বাচন ও মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠন করার আগেই মহানগর আওয়ামী লীগের ১১৯ জন নেতাকে শোকজ দেওয়া হলো।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর মহানগর আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় জাহাঙ্গীর আলম বহিস্কার হওয়ার পরও তার সঙ্গে যারা বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন বা সখ্যতা বজায় রেখেছেন তাদের চিহ্নিত করতে ১১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ওসমান আলীকে ওই তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ওই ১১৯ নেতাকে শোকজ করা হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ স¤পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতি কটূক্তি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ কর্তৃক তাকে শোকজ ও পরবর্তীতে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। দল থেকে তাকে শোকজ নোটিশ প্রদান এবং পরবর্তীতে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার পরেও দলীয় কিছু নেতা কর্মী দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সাথে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দলীয় পদ-পদবী ব্যবহার করে যেগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এতদ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের গত ৫ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে কার্যকরী কমিটির সভায় ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত কমিটির এক নেতা জানান, শোকজ প্রাপ্তদের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে শোকজের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তবে শোকজ নোটিশে স্বাক্ষর করা গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আতাউল্যাহ মন্ডলের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

উক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যাদের বিষয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদেরকেই শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশ প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারার বিধান মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা অত্র নোটিশ প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে মহানগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতাউল্যাহ মন্ডলের নিকট লিখিতভাবে জবাব দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। ব্যার্থতায় তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গঠনতন্ত্রের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শোকজের তালিকায় থাকা বেশ কয়েকজন নেতা শোকজের চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করলেও অনেকে ওই চিঠি গ্রহণ করেননি।

শোকজের চিঠি পাওয়া গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুনেছি শতাধিক নেতাকে বহিঃস্কার করার জন্য শো’কজ নোটিশ পাঠানো শুরু হয়েছে। গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের বহিস্কৃত ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এই শো’কজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ আছে। তারা বলেন, সামনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আর সিটি নির্বাচনও এগিয়ে আসছে। এ সময়ে তুচ্ছ অযুহাতে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের দল থেকে বাদ দেওয়া এবং দলের কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা দলের জন্য শুভকর নয়।

২০২১ সালের ১৯ নবেম্বর গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় পদ থেকে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ। এর কয়েক দিন পর গাজীপুর সিটি মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটুক্তি করার অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে সরকার ও দল এই ব্যবস্থা গ্রহন করে। একই সঙ্গে বিষয়গুলো তদন্তের জন্য সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা হয়। মামলাগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন ও সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগকে ঢেলে সাজানোর জন্য বেশ কিছু নেতাকে বহি:স্কার করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেতারা বলেছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ এখনো আদালতে প্রমানিত হয়নি এবং তিনি নির্দোষ প্রমানিত হলে যে কোন মুহুর্তে দলে ফিরতে পারেন। জাহাঙ্গীর আলম দলে ফিরে আসার আশংকায় দলে তার অনুসারীদের প্রভাব কমাতে জাহাঙ্গীর আলম বিরোধী নেতারা তড়িঘড়ি করে বহিস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন।

তবে জাহাঙ্গীর বিরোধীদের দাবি, দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শোকজ’র বিষয়ে দলের মাঝে কোন প্রভাব পড়বে না। বরং দলের প্রতিটি নেতা-কর্মী গঠণতন্ত্র মেনে চলবে। এতে দলের মাঝে সুশৃঙ্খল বজায় থাকবে।