১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নীল আর্মস্ট্রং প্রথম মানব হিসেবে চাঁদে পা রাখেন। তিনি যে মহাকাশযানে করে চাঁদে অবতরণ করেন তার নাম ছিল এপোলো-১১। চন্দ্রযানটিতে ব্যবহৃত গাইডেন্স কম্পিউটারের মেমোরি ছিল ৩২,৭৬৮ বিট বা প্রায় ৪ (চার) কিলোবাইটের সমান। বর্তমানে আমরা এর চেয়ে শত কোটিগুণ শক্তিশালী কম্পিউটার আমাদের পকেটে নিয়ে ঘুরি। যে ভার্সনটির নাম মোবাইল ফোন। জ্ঞানার্জনের জন্য এখন আর সুদূর চীন দেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনা; ঘরে বসেই আঙ্গুলের খোঁচায় বিশ্বের সকল জ্ঞানকোষ আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই কতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।

দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বস্তুটি হল মোবাইল ফোন। দ্রুততম সময়ে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের তথ্য জানা এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে এই মোবাইল ফোন। কোভিড-১৯ অতিমারির সময় এই ডিভাইসটির উপকারিতা আরও ভালোভাবে টের পাওয়া গেছে। ঘরবন্দী অবস্থায় অফিস, পড়াশোনা, চিকিৎসা, খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস ডেলিভারিসহ প্রতিনিয়ত প্রায় সকল কাজের হাতিয়ার ছিল মোবাইল ফোন। তবে চাঁদেরও যেমন কলঙ্ক আছে, মোবাইল ফোনও এর ব্যতিক্রম নয়।

এর সঠিক ব্যবহারের অভাবে তৈরি হচ্ছে মোবাইল আসক্তি। যার প্রধান কারণ বলা যায়, অসচেতনতা ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। শিশুরা স্বভাবজাতভাবে অনুকরণপ্রিয়, পরিবেশে যা দেখে তাই অনুকরণের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা প্রধান অনুকরণীয়। দৈনন্দিন প্রয়োজনে পিতা-মাতাকে মোবাইলে কথা বলাসহ সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহার ও বিভিন্ন খবরাখবর নিতে হয়; আবার অনেকে অবসর সময়ে বিভিন্ন গেমস খেলেন। এসবই শিশুদের কোমল হৃদয়ে মোবাইলের প্রতি আগ্রহের জন্ম দেয়। অনেক পিতা-মাতা শিশুদের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। আবার কেউ কেউ ফোনে ভিডিও শিশুদের দেখিয়ে খাওয়ান, শিশুকে ব্যস্ত রাখতে বিভিন্ন গেমস ও এপস চালিয়ে দেন। এভাবেই ধীরে ধীরে জীবন সম্পর্কে বোঝার আগেই মোবাইল ফোনের ছোট স্ক্রিনটাই কোমলমতি শিশুর পুরো জগত হয়ে ওঠে। এর সাথে অনলাইন সাইটগুলোতে থাকছে রঙিন এবং লোভনীয় সব বিজ্ঞাপন ও পুরস্কারের হাতছানি। যাতে ধীরে ধীরে শিশুদের হৃদয়ে তৈরি হচ্ছে টাকা উপার্জনের নেশা। ফলে ইউটিউব, টিকটক, গেমস এসবের সাথে যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করা যায় এমন লোভনীয় অফারে হিতাহিতজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। সারাদিন এসবের পেছনেই পড়ে থাকছে শিশু-কিশোররা। একসাথে চলাফেরা করে, খেলাধুলা করে বানানো বন্ধুর চেয়ে এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ার বন্ধুর গুরুত্বই বেশি।

শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন খুবই প্রয়োজন। কিন্তু, পিতা-মাতা কর্মব্যস্ততার অযুহাতে তাদের সেই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। একদিকে খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত মাঠ নেই, অপরদিকে খেলার মাঠ দখল করে নিচ্ছে ভার্চুয়ালজগৎ। পাবজি, ফ্রি-ফায়ারসহ আরও অনেক চটকদার গেমসে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে শিশু-কিশোররা। টিকটক-লাইকি নামক বিনোদনের মাধ্যম আজ অভিশাপে রূপ নিয়েছে।টিকটক অ্যাপে ভিডিও তৈরি করা ও ফ্যান-ফলোয়ারের দিক দিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যত্রতত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিশোরগ্যাং। কিশোররা হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক। তাদের মধ্যে সহনশীলতা ক্রমেই কমে আসছে। সমঝোতার পরিবর্তে সহিংসতার পথ বেছে নিচ্ছে তারা। বেপরোয়া মনোভাবের কারণে খুব সহজেই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোরগ্যাং। মাদক সেবন, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি ও যৌন নিপীড়নসহ খুনের মতো লোমহর্ষক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্যাংয়ের শিশু-কিশোররা। এতে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, বিশৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। পরবর্তীতে মোবাইলে আসক্ত এসব শিশু-কিশোরদের প্রতি পিতা-মাতা যখনই একটু কঠোর হতে যাচ্ছে তখনই আত্মহত্যার মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটছে অহরহ।

সোশ্যাল মিডিয়ার জগতকে শিশু-কিশোররা আসল জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলছে। ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদিতে কোনো ছবি বা ভিডিওর বিপরীতে কতটি লাইক বা কমেন্ট আসছে সেটি এখনকার শিশু-কিশোরদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। লাইক-কমেন্ট কম পাওয়া মানে তোমার জীবন তুচ্ছ- এমন একটি ধারণা কিশোরদের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, বিষন্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনভাবে বাড়ছে।

এসব মোবাইল ডিভাইস থেকে নির্গত আলোরশ্মি চোখের ক্ষতি করে। দীর্ঘক্ষণ চোখের সামনে মোবাইল নিয়ে থাকায় চোখের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়, ফলে খুব কম বয়সেই চোখ ও মস্তিষ্কসহ শরীরের নানান অংশে জটিলতা দেখা দেয়। যেমন: মেলাটোনিন নামক যে হরমোন আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে, রাতজাগার ফলে নিঃসরণ কমিয়ে দেয় এসব ডিভাইস; যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয়ক্ষেত্রেই সমস্যা সৃষ্টি হয়। সারাক্ষণ ডিভাইস ব্যবহারের ফলে আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লক সামঞ্জস্য হারায়। এর কারণে স্থূলতা ও ডায়াবেটিস বেড়ে চলছে। মোবাইল ডিভাইস থেকে নির্গত রেডিয়েশনে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হয়; ব্রেইন টিউমারের মতো বড় ধরনের সমস্যাও সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে দু’টি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল; যা কেড়ে নিয়েছিল লক্ষাধিক প্রাণ। সেই ধ্বংসযজ্ঞের পর আমাদের বোধদয় হয় পারমাণবিক বোমা আর ব্যবহৃত হয়নি। তবে, একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি।

একইভাবে মোবাইল ফোন প্রযুক্তিরও খারাপ দিকের সাথে সাথে ভালো দিকও রয়েছে। শিশু-কিশোরদেরকে সেই ভালো দিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের সর্বোত্তম আশ্রয়স্থল হচ্ছে পরিবার। অভিভাবকরা কম বয়সেই সন্তানের হাতে দামি মোবাইল ফোন তুলে দেন, এটি বন্ধ করতে হবে। খেলাধুলার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। বইপড়া, ধর্ম, বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার অভ্যাস গড়তে হবে। অভিভাবককে সন্তানদের সময় দিতে হবে। তথ্য ও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সন্তানদের সাথে আলোচনা করতে হবে। ছুটির দিনে সপরিবারে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। পড়াশুনার ব্যাপারে তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে শিশুকালেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। প্রযুক্তিবিমুখী নয় বরং প্রযুক্তিকে কিভাবে নিজের এবং সমাজের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায় সে ধরনের শিক্ষা দিতে হবে। তবেই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন গড়ে উঠবে।

রাফিদ আল তাহমিদ
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী