বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ শিকার চলতে থাকলে এক সময় পুরো সুন্দরবন এলাকা মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রায়ের অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে।

রায়ে আদালত বলেন, ‘বিষ নিয়ে মাছ শিকার করলে কিংবা চারু পদ্ধতির মাধ্যমে কাঁকড়া শিকার করলে ওই নৌকার সব আরোহীকে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।’

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আল ফয়সাল সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

অ্যাডভোকেট আল ফয়সাল সিদ্দিকী জানান, নিবন্ধিত ট্রলারে পশুর নদী ব্যবহার করে দুবলার চর থেকে সব ধরনের মাছ পরিবহনের অনুমতি আছে বন বিভাগের। তবে, কাঁকড়া বহনের অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না। ফলে, কাঁকড়া ধরার পর খুলনায় আনতে দেরি হওয়ায় অনেক কাঁকড়া মারা যেত।

এ অবস্থায় অন্যদের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি চেয়ে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রধান বন সংরক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেন দাকোপ ও বটিয়াঘাটাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কাঁকড়া আহরণকারী জেলেরা। কিন্তু বন বিভাগ ওই আবেদনে সাড়া না দেয়ায় জেলেরা ওই বছরই হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট ৩০ দিনের মধ্যে ওই আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।

এরপর বন বিভাগ থেকে ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর আবেদনকারীদের জানানো হয় যে, কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি দেয়া হবে না। এরপর বন বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জাহান আলী গাজীসহ আটজন ২০১৯ সালে রিট আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট।

রায়ে আদালত বলেন, ‘এক শ্রেণির জেলে সুন্দরবন থেকে মাছ আহরণ করার জন্য পাস সংগ্রহ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত খালগুলোতে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ আহরণ করে। ফলে বিষ প্রয়োগ করা খালে সব প্রকার জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ নষ্ট হয়ে যায়। এমন কাজ অত্যন্ত নিকৃষ্ট। এভাবে বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ আহরণ করা অব্যাহত থাকলে এক সময় পুরো সুন্দরবন এলাকা মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।’

হাইকোর্টের রায়ের সাত দফা নির্দেশনাগুলো হলো :

১) রিটকারীরাসহ কাঁকড়া জেলেরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুন্দরবনের সংশ্লিষ্ট স্টেশন অফিসে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে পাস (অনুমতি) সংগ্রহ করে কেবল বৈঠা চালিত নৌকা এবং ‘দোন দড়ি’র মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজনের কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন।

২) কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত এলাকার খালের ভেতরে কোনো প্রকার ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার চলাচল করা যাবে না। এজন্য বন বিভাগসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চলাচলকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে।

৩) পাস নিয়ে কাঁকড়া আহরণের জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বন বিভাগের স্টেশন অফিস থেকে কঠোরভাবে সংশ্লিষ্ট নৌকা ও নৌকার লোকদের পরীক্ষা করতে হবে, যাতে কোনো প্রকার ‘চারু’ (কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের শোলা দ্বারা নির্মিত চাঁই, যা স্থানীয়ভাবে চারু নামে পরিচিত) এবং ‘বিষ’ কিংবা অন্য কোনো বেআইনি বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে দিনের বেলা তাদের নৌকা পরীক্ষা করে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেয়া সমীচীন হবে।

৪) প্রতিটি নৌকা পাস নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশকালে তাদের জন্য কী কী করণীয় এবং কী করা দণ্ডনীয় সে সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল/পোস্টার সরবরাহ করা যেতে পারে।

৫) যেহেতু সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদী ও খালগুলো থেকে মাছ আহরণের পর তা জেলে পল্লী দুবলা থেকে সংগ্রহ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারের মাধ্যমে পরিবহন করে বাজারজাত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেহেতু অনুরূপভাবে বৈঠাচালিত নৌকা দ্বারা কেবল ‘দোন দড়ি’ পদ্ধতিতে কাঁকড়া আহরণ করে তা দুবলা জেলে পল্লীসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অন্য যেকোনো স্বীকৃত স্থানে, যেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকার/ট্রলারের যাতায়াতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখান থেকে সংগ্রহ করে দ্রুত বাজারজাত করার জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে পরিবহনের অনুমতি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনচালিত নৌকা/ট্রলারে কাঁকড়া পরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে এবং ওই সব ইঞ্জিনচালিত নৌকা/ট্রলার সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশকালে স্থানীয় স্টেশন অফিস কর্তৃপক্ষ ওই নৌকা/ট্রলার কঠোরভাবে পরীক্ষা করে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে, যাতে কোনো প্রকার বেআইনি জিনিস, যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ধ্বংস করতে পারে, তা যেন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতে না পারে।

৬) সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়মিতভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাজার, ওষুধের দোকানসহ কৃষির জন্য সার, ওষুধ ও বীজ বিক্রির দোকানগুলোতে অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে ওই এলাকায় অননুমোদিত কোনো বিষ বিক্রি করা না হয়।

৭) পাস সংগ্রহ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশকালে কিংবা সুন্দরবনে অবস্থানকালে কাঁকড়া জেলেসহ মৎস্য জেলে ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে কোনোরূপ বেআইনি দ্রব্য পাওয়া গেলে তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।