বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজ এই সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা, এখন বাংলাদেশকে যুদ্ধে জড়াতে চেষ্টা চলাচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে নিরব সম্পর্ক আর রাশিয়া সরাসরি সমর্থন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বড় অন্তরায় বলেই দাবী করেছে বিসিবি বাংলা। এছাড়া বিসিবি বাংলা তাদের রিপোর্টে স্পষ্ট করেই তিন দেশ ছাড়াও আসিয়াভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের বন্ধুত্ব আর ব্যবসায়ী সম্পর্ক তুলে ধরেছে। বিসিবি বাংলার রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে বাংলাদেশ কেন রোহিঙ্গা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গা ইসু্-টি দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। বিসিবি তাদের এক রিপোর্টে আজ বলেছে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমারে আবারো সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সবসময়ই সবকিছু পরিচালনা করেছে।

সামরিক সরকার এখন মিয়ানমারে গণতন্ত্র-পন্থী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে। বিসিবি বাংলায় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, এতো কিছুর পরেও মিয়ানমার কিংবা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কেন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারছে না? এর জবাবটাও বিসিবি বাংলাই দিয়েছে। বলা হয়েছে, এর বড় কারণ মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব।

ভারতের স্বার্থ কোথায়? – বিসিবি বাংলা

ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে। এছাড়া বঙ্গোবসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার ১৯৫১ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন হলেও ভারত কড়াভাবে সেটির নিন্দা করতে পারেনি। মিয়ানমারে বিভিন্ন সময় দমন-পীড়ন নিয়ে ভারত উদ্বেগ জানালেও তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি।

সংকটের শুরুর দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যত প্রস্তাব এসেছিল সেগুলোতে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। ভারতের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে। অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আছে মিয়ানমারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ এবং বিভিন্ন বিরল প্রাকৃতিক পদার্থ ভারতের তথ্য প্রযুক্তি খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাছাড়া মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মিয়ানমার হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী। তাছাড়া ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের আশংকা চীনকে নিয়ে। চীন যদি মিয়ানমারে একক আধিপত্য পেয়ে যায় তাহলে মিয়ানমারকে ব্যবহার করে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই আশংকা থেকেই ভারত মিয়ানমারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে বলে উল্লেখ করেন মি. কবির।

পশ্চিমারা কিছু করতে পারছে না- বিসিবি বাংলা

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমার ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো শক্ত অবস্থানে আছে। রোহিঙ্গা সংকট এবং সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের কর্মকর্তাদের উপর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো কিছু নিষেধাজ্ঞা দিলেও এর চেয়ে বেশি কার্যকরী কিছু তারা করতে পারেনি। এর পেছনেও একটি দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চায় না।

দু’হাজার এগারো সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা দেশটিতে ভিড় করতে শুরু করে। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের দিকই তাদের নজর ছিল। জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, হোটেল, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছিল পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশটির মোট জিডিপির ছয় শতাংশ হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ।

ইউরোপিয়ান কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে চীন, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের পরে মিয়ানমারের চতুর্থ ব্যবসায়ী-অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উভয় পক্ষের মধ্যে বছরে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়। সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর নরওয়ের টেলিনরও বিনিয়োগ করেছিল। যদিও ২০২১ সালে সামরিক শাসন পুনরায় ফিরে আসার পরে টেলিনর তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি লেবাননের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মিয়ানমার ত্যাগ করে।

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আয় আসে তেল গ্যাস বিক্রি থেকে। তাদের রাজস্ব আয়ের অর্ধেক আসে এই খাত থেকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা দেশটির তেল-গ্যাস ফান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবার দাবি তুলেছিলে। কিন্তু পশ্চিমা কোম্পানিগুলো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো চাইলে মিয়ানমারের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ দিতে পারে। কিন্তু সেটা তারা দিচ্ছে না। “আমার ধারণা এটা তারা দিচ্ছে না কারণ এটা দিলে সাধারণ মানুষ বেকায়দায় পড়বে,” বলেন মি.কবির।

সূত্র : বিসিবি বাংলা