সুজা তালুকদার চট্টগ্রাম থেকে

প্রশাসনের উপস্থিতিতে বানানো বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের মঞ্চ শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে নিজেদের দখলে নিয়েছে। মুল ঘটনা ছিল আগের রাতে মহালয়ার আগের রাতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ের মেধস মুনির আশ্রমে পূজা কমিটির বানানো মঞ্চ দখলে নেয় স্থানীয় হিন্দু সমাজ। মুখোমুখি দুই গ্রুপ, সংঘাতের শংকা।

চট্টগ্রাম থেকে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, মহালয়ার আগের রাতে সনাতনী সম্প্রদায়ের অন্যতম জনপ্রিয় মেধস মুনির আশ্রমজুড়ে সংঘাতের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পূজা উদযাপন পরিষদের অনুষ্ঠান ঠেকাতে মন্দিরের পুরো এলাকাজুড়ে পাহারায় থাকে পাঁচ শতাধিক মানুষ। সকালে পূজা উদযাপন পরিষদের নামে বহিরাগত লোকজনকে প্রতিহত করতে স্থানীয় নারী-পুরুষ সকলে যোগ দেবেন বলেও জানান অনেকে।

এর আগে শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা এ আশ্রমে আগের মতো অনুষ্ঠান করতে ট্রাকে করে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র পাঠায়। তবে ডেকোরেশন সামগ্রী নিয়ে আসা ট্রাকটি এদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় হিন্দুদের বাধার মুখে মন্দিরের সামনে থেকে ফিরে যায়। এরপর সন্ধ্যা থেকে আশ্রম ঘিরে পাহারা বসায় স্থানীয় হিন্দুরা।

শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দিনের বেলা উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপে মহালয়ার অনুষ্ঠান করতে এ আশ্রমে মঞ্চ তৈরি করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও পরিষদের জেলা শাখা। তবে রাতে হিন্দু সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু সমাজ এ মঞ্চ নিজেদের দখলে নেয়। এর ফলে দুর্গা পূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্বীকৃত মেধস মুনির আশ্রমে মহালয়ার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও স্থানীয় হিন্দু সমাজের মধ্যে তৈরি হওয়া সংঘাতের শঙ্কা আরও বাড়ে।

জানা গেছে, গত বছর মহালয়ার দিন আশ্রমে ঘটেছিল ন্যাক্কারজনক ঘটনা। সেদিন আলোচনা সভার অজুহাতে যজ্ঞ বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ। ২০২১ সালের সেই মহালয়ার দিন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারা ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজকে মারধর করেছিলেন। এবার কোনোভাবে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না স্থানীয় হিন্দু সমাজ।

দেবীভগবত পুরাণ মতে, দেবী দুর্গা দুনিয়ায় সর্বপ্রথম ঋষি মেধসের এই আশ্রমে নেমে এসেছিলেন। তাই সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই আশ্রম অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত ও দর্শনার্থীতে মুখরিত থাকে এ আশ্রম। প্রতি বছর মহালয়া ও দুর্গা পূজাতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ভক্ত এবং দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এ আশ্রমে। তবে এ আশ্রমে এবারের দুর্গাপূজায় মহালয়ার আয়োজনকে ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরির পেছনে জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের হাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আশ্রমের সেবায়ত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজ।

বুলবুলানন্দ মহারাজ বলেন, ‘মেধস মুনির আশ্রমে আমি ২০০২ সাল থেকে টানা ২০ বছর ধরে সেবায়ত হিসেবে রয়েছি। গত ২৫ আগস্ট আমি ভারত গিয়েছিলাম। আমার ভারত যাওয়ার পরের দিন তড়িঘড়ি করে নিয়মবহির্ভূত সভা করে একটা অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়। বিধান অনুযায়ী কমিটি গঠনে স্থানীয় সাংসদ ছাড়াও উপজেলা প্রশাসন ও সেবায়েতের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন থাকলেও তা মানা হয়নি। ওই সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-৮) মোছলেম উদ্দিন আহমদ দেশেই ছিলেন না। তিনি তখন সিঙ্গাপুর ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে কমিটি গঠন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেটাও না মেনে নিয়মবহির্ভূতভাবে অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়। তবে তারা চাইলেও অবৈধ কমিটি এ আশ্রমে এবারের মহালয়ার দিন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না। এদিন বিভিন্ন যজ্ঞসহ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে আশ্রমের পক্ষ থেকে। ভক্ত হিসেবে যে কেউই আসতে পারবেন। তবে এখানে কাউকে অশাস্ত্রীয় কার্যকলাপ নিয়ে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না।’

স্থানীয় হিন্দুরা বলেন, গত বছরের মহালয়ার দিনও অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের দিয়ে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করেছে পূজা উদযাপন পরিষদ। তাদের এমন অশাস্ত্রীয় কাজে বাধা দিতে গিয়ে সেবার সাধুও মারধরের শিকার হয়েছিলেন। এবারও তারা একই পাঁয়তারা করছে। আমরা স্থানীয় হিন্দু সমাজ এটা আর হতে দেব না। তাদেরকে কোনোভাবেই অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না। যেভাবেই হোক আমরা এবার তাদের প্রতিহত করব। আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুনও বানিয়েছি।

এছাড়া স্থানীয় হিন্দু নেতারা বলেন, মেধস মুনির আশ্রম দখলে নিতে পাঁয়তারা করছে দখলদাররা। তারাই হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করে টুকরো টুকরো করে রেখেছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজা আসলেই হঠাৎ জেগে ওঠে তারা। শহর থেকে গায়িকা এনে গান গাওয়া কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না। গত বছর মন্দিরে অনুপ্রবেশ করে চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং সম্পাদক অসীম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজকে মারধর করেছিলেন।

তারা বলেন, কি স্বার্থে এরা এখানে অনুপ্রবেশ করছে? আমরা স্থানীয়রা কি মরে গেছি? এবার এ ধরনের কেউ অনুপ্রবেশ করে ইজ্জত নিয়ে মন্দির থেকে ফিরে যেতে পারবে না। জীবনের বিনিময়ে হলেও এবার অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করা হবে।

এজন্য পদক্ষেপ নিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন বলেও জানান তারা।

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট বোয়ালখালী আমুচিয়া ইউনিয়ন শাখা কমিটির আহ্বায়ক সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং এর চট্টগ্রাম জেলার নেতারা মেধস মুনির আশ্রমে তাদের লোকজন ও পুলিশ নিয়ে যেভাবে মঞ্চ বানানোর নজির দেখিয়েছে, এটা খুবই ন্যাক্কারজনক। নেতা হতে এতো হুঙ্কার না দিয়ে নির্যাতিত হিন্দু পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে এমন পেশিশক্তি যদি দেখাতো, তাহলে এত হিন্দুকে আজ বাংলাদেশ ছাড়তে হতো না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে তাদের বানানো মঞ্চ দখলে নিয়েছি। যদি প্রশাসন বা পুলিশ নিয়ে পূজা উদযাপন পরিষদ এটি দখলের চেষ্টা চালায়, তাহলে স্থানীয় হিন্দু সমাজ প্রতিরোধ করবে। এতে যদি কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটে, এর দায়ও পূজা উদযাপন পরিষদ এবং প্রশাসনকে নিতে হবে।’