মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার নামে লোকজনকে আকৃষ্ট করে মানব পাচার চক্রের সদস্যরা। বিদেশে পাঠানোর খরচ হিসেবে তারা ৪-৮ লাখ টাকা নেয়। শেষে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে নেওয়ার পর বেরিয়ে আসে তাদের ভিন্ন রূপ। চাকরিপ্রত্যাশীদের গোপন স্থানে আটকে রেখে পাসপোর্ট ও সঙ্গে থাকা অর্থ কেড়ে নেওয়া হয়। শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।একপর্যায়ে প্রতারিত ব্যক্তিরা দেশে আসার জন্য আবারও ৫-৬০ হাজার টাকা দিয়ে চক্রের কাছ থেকে পাসপোর্ট ফেরত নেন।

এমন প্রতারণায় জড়িত একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৩। তারা হলেন- চক্রের অন্যতম হোতা তোফায়েল আহমেদ, তার সহযোগী আক্তার হোসেন, আনিছুর রহমান ও মো. রাসেল। আজ সোমবার সকালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও রাজধানীর গুলশান এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৬টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক বই, ৪টি স্ট্যাম্প, ৫টি মোবাইল ফোন, ৪টি বিএমইটি কার্ড উদ্ধার করা হয়।

এ ব্যাপারে জানাতে আজ দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশে ভালো চাকরির প্রলোভনে পড়ে ভুক্তভোগীরা রাজি হলে প্রথমে তাদের পাসপোর্ট এবং প্রাথমিক খরচ বাবদ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নেওয়া হয়। এরপর তাদের অভিভাবকদের বিদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে ফোন দিয়ে আশ্বস্ত করে যে, তোফায়েল আহমেদদের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে তারা খুব ভাল আছেন। অনেক টাকা উপার্জন করে তারা ভাগ্য বদলে সক্ষম হয়েছেন। পরের ধাপে পরিবহন খরচ, ভিসা খরচ, মেডিকেল খরচ, বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদির কথা বলে আসামিরা ধাপে ধাপে টাকা নিতে থাকেন। তবে বিমানে ওঠার আগে আসামিরা ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট, ভিসা বা টিকিট কিছুই হস্তান্তর করেন না। শুধু নির্দিষ্ট তারিখে লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হতে বলেন। ফ্লাইটের দিন বিমানবন্দরের প্রবেশ গেটে পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট হস্তান্তর করা হয়। ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন, তাদের ভ্রমণ ভিসায় বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। তখন আসামিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছাড়া তাদের কিছুই করার থাকে না। আসামিরা তখন আশ্বস্ত করে, বিদেশ যাওয়ার পর তাদের ওয়ার্কিং ভিসা করে দেওয়া হবে।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, বিদেশে পৌঁছার পর দুবাই প্রবাসী জাহিদ ভুক্তভোগীদের স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এরপর তাদের পাসপোর্ট এবং নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে তাদের একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর কোম্পানি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আইনী জটিলতার কারণে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তারপর জাহিদ পুনরায় ভিকটিমদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় শুরু করে। ওই সময়ে তাদের খাবার দেওয়া হয় না। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে খাবার কিনতে বলে। তখন তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে অপেক্ষা করতে বলে। সে জানায়, আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। কিন্তু একপর্যায়ে ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে ফেরার পথ খোঁজেন। তখন জাহিদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ফেরত নিতে হলে আবারও ৫০ হতে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। এরপর ভিকটিম দেশে এলে তোফায়েল তাকে এবং তার অভিভাবককে উল্টো দোষারোপ করেন। সে দাবি করে, ভিকটিম আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভালো কাজের সুযোগ পেত।

র‌্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, আসামিদের ট্রাভেল এজেন্সি বা রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচালনার কোনো লাইসেন্স নাই। তারা শুধু সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে মানবপাচার ব্যবসা করছিল। স্বল্প সময়ে, বিনাশ্রমে অধিক লাভ বা অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ভিকটিমরা বিদেশ গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার এবং আর্থিকভাবে সর্বশান্ত হলেও আসামিদের কোনো অনুশোচনা নেই।