অনলাইনে জুয়া খেলে হাজার হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগে মাষ্টার এজেন্টসহ অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের ৯ যুবককে গ্রেফতার করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। সদর থানা পুলিশ গাজীপুর ও উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনার সঙ্গে একটি ব্যাংক জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহষ্পতিবার জিএমপি’র কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম তার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেসব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।

গ্রেফতারকৃতরা হলো- শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি (মৃধাবাড়ী) গ্রামের মৃত হাবিবুল্লাহ মৃধার ছেলে নাসির মৃধা (৩০), ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার গৌরীপুর (মধ্যপাড়া) গ্রামের ফরহাদ আলীর ছেলে মারুফ হাসান (২৪) ও ফরহাদ আলীর ছেলে আশিকুর রহমান ওরফে আশিক (২৭), ভালুকজান গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম ওরফে রসুল (২২) ও সাবেদ আলীর ছেলে আকরাম হোসেন ওরফে রিপন (২৬), চৌদার গ্রামের জুলহাসের ছেলে কাউসার হোসেন (২৩), বড়–কা গ্রামের নুরুল ওয়াদুদের ছেলে রুবেল হোসেন (২৫), কয়ারচালা গ্রামের করিমের ছেলে আশিকুল হক (২৫) এবং গৌরিপুর পৌরসভা এলাকার আলমগীর কবিরের ছেলে মুরাদ হোসেন (২৫)। তাদেরকে রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে দুপুরে গাজীপুর আদালতে পাঠানো হয়েছে।

জিএমপি’র কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে অবৈধ অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের উঠতি বয়সীদের আসক্ত করে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নেওয়া হচ্ছে। এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জিএমপি’র সদর থানা পুলিশ ওই চক্রের মূল হোতা মাষ্টার এজেন্ট নাসিরকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্য, ব্যবহৃত মোবাইলের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং ও মোবাইল ব্যাংকিং ওয়ালেট যাচাই করে তার কাছে রুট লেভেলের প্রায় ৭০ জন ব্যবহারকারীর তথ্য পাওয়া যায়। নাসির তাদের কাছ থেকে দৈনিক লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করে তার ঊর্ধ্বতন সুপার এজেন্ট মারুফের কাছে দিতেন। মারুফকে গ্রেফতারের জন্য উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অভিযান চালানো হলে তার সঙ্গে আরও সাতজন জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল চেক করে মেসেঞ্জার, হোয়টাসএ্যাপ চ্যাটিং ও এমএফএস (বিকাশ/নগদ/রকেট) দেখা যায় উর্ধ্বতন সাইট সাব এ্যাডমিন হককে (ওয়েবসাইট নেম) ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকের ১৪৮টি একাউন্টে গত নবেম্বর মাসে ২ কোটি টাকার অধিক লেনদেন হয়েছে। এক মাসেই প্রায় ১৫০০ টি মাস্টার এজেন্টের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকার অধিক লেনদেন হয়েছে। যা বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে একটি ব্যাংক জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বিষয়টি স্বীকার করেছে।

তিনি গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান, তারা মোবাইল, বিকাশ, রকেট ও ব্যাংক হিসাব এবং বাংলাদেশে অবৈধ অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম ভেলকি লাইভ (velki live, সাবেক নাম 9Wickets) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে গুগল ক্রম (Google chorme) ব্রাউজার ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের উঠতি বয়সের যুবকদের আসক্ত করে। তারা মালোয়েশিয়া/দুবাইয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে হোয়াটস্ অ্যাপ বিজনেস একাউন্ট খুলে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে যোগাযোগ করে থাকে। তাদের ব্যবহৃত সার্ভারটি ভেলকি লাইভ এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা আকাশ মালিক ওরফে রনি (বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দুবাই প্রবাসী) নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আকাশ মালিক ওরফে রনি এটিকে ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিদেশী নাম্বার ব্যবহার করে বাংলাদেশের ৫টি লেয়ারে তথ্য এ্যাডমিন, সাইট সাব এ্যাডমিন, সুপার এজেন্ট, মাষ্টার এজেন্ট এবং ইউজার (রুট লেভেলের ব্যবহারকারী) লেয়ারে বিভক্ত করে। প্রতিটি লেয়ার তার উপরের লেয়ারের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকে। তার মধ্যে একজন রুট লেবেলের আগ্রহী অনলাইন জুয়ারী https://allagentlist.com/ad.php ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে ক্লিক করলেই ১০০০ টাকার বিপরীতে ১০ টি ডিজিটাল কয়েন প্রদান করে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়।

পুলিশ কমিশনার আরো জানান, এই ডিজিটাল কয়েনের মাধ্যমে মুলত সারা বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট, ফুটবললীগ, টেনিস এবং চলমান বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় প্রধানত অনলাইনে বাজী ধরে জুয়া খেলা ও লেনদেন হয়। ব্যবহারকারী জয়ী হলে ডিজিটাল কয়েন ফেরত নিয়ে এর বিপরীতে আর্থিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে থাকেন। আর হেরে গেলে তার পুরো ডিজিটাল কয়েনই পর্যায়ক্রমে জুয়া পরিচালনাকারীর কাছে জমা হয়ে যায়। ওই ভেলকি লাইভ এর ওয়েবসাইটে একজন এডমিন, ১৪ জন সাইট সাব এডমিন, ২৪০ জন সুপার এজেন্ট, দেড়হাজারের অধিক মাষ্টার এজেন্ট এবং সারা দেশে প্রায় দুই লক্ষাধিক ইউজার রয়েছে।

জিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার আলমগীর হোসেন জানান, বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার মাস্টার এজেন্টের মাধ্যমে এক মাসেই তিন হাজার কোটি টাকার অধিক লেনদেন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, যা হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের ব্যবহৃত মোবাইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং ও মোবাইল ব্যাংকিং ওয়ালেট যাচাই করে এ ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় জিএমপি’র সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। এছাড়াও সিআইডি কর্তৃক মানিলন্ডারিং আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ জিয়াউল হক ও মোঃ দেলোয়ার হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইলতুৎ মিশ, মোঃ মিজানুর রহমান, মোঃ হুমায়ুন কবির, মোঃ মাহবুব-উজ-জামান, মোঃ আরিফুল ইসলাম, আবু তোরাব মোঃ শামছুর রহমান ও মোঃ আলমগীর হোসেন, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রেজওয়ান আহমেদ, সহকারি পুলিশ কমিশনার একেএম আহসান হাবীব ও চৌধুরী মোঃ তানভীর উপস্থিত ছিলেন।