রাঙ্গুনিয়ার একঝাঁক যুবক স্বশরীরে ভারতের দেমাগগিরিতে ট্রেনিং শেষে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে লাল সবুজের পতাকা হাতে দেশ স্বাধীন করেছে প্রয়াত প্রিয়দর্শী বড়ুয়ারা। মুক্তিযোদ্ধা কেতাব মিললেও নাম সংশোধন হয়নি স্বাধীনতার ৫২ বছরেও। বছরের পর বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় হয়েছে ঠিকই, সংশোধন হয়নি নাম, বঞ্চিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পারুয়া ইউনিয়ন ৯ নং ওয়ার্ড অন্তর্গত পূর্ব সাহাব্দিনগর সোনাইছড়ি গ্রামের প্রয়াত চিন্তাহরণ বড়ুয়ার পুত্র প্রয়াত প্রিয়দর্শী বড়ুয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধকালীন ১ নম্বর সেক্টরে রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেন। রাঙ্গুনিয়া বীর মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে প্রিয়দর্শী বড়ুয়া একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সু-পরিচিত। স্বাধীনতার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় হতে মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় সেক্টর তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোঃ কাশেম (খুলনা) এর মুক্তিযোদ্ধা ই-আর্কাইভ প্রকাশিত তালিকায় ৩০ হাজার ৯শত ৯৭জন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪৪৪ নাম্বারে তার নাম উল্লেখ রয়েছে।

তবে পরিতাপের বিষয় ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ভুলবশত প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার স্থলে প্রিয়দর্জি বড়ুয়া পিতার নাম চিন্তা হরণের স্থলে চিতালাল বড়ুয়া ও পূর্ব সাহাব্দিনগর সোনাইছড়ি স্থলে সাহাব্দিনগর সাইছড়ি লিপিবদ্ধ করা হয়। এই ভূলের কারণে তিনি রাঙ্গুনিয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রথম সারির যোদ্ধা হয়েও তার জীবদ্দশায় সরকারের কোন প্রকার প্রণোদনা ছাড়াই মৃত্যু কালে পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে করুণ অবস্থায় পরলোক গমন করতে হয়। তার কন্যা অনলাইনে (১০১নং) আবেদন করেন, পরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে নিয়মিত আসা যাওয়া করেও কোন ফলশ্রুত হয়নি। সুশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা কারণে মানবেতর জীবন যাপন করলেও বঞ্চিত হয়েছে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে।

উল্লেখ্য, তৎকালীন ব্রিটিশ পিরিয়ডে রানী এলিজাবেথ সম্মাননা স্বাক্ষর স্বরূপ “রায় সাহেব” এর কেতাবে ভূষিত ৫নং পারুয়া ইউনিয়নের ১৫ বছরের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থাকা “বাবু ললিত মহন বড়ুয়া’র নাতি প্রিয়দর্শী বড়ুয়া যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ সরকারের দেশ রক্ষা বিভাগের ১১৮১৭১ নাম্বার স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদ পেয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দেশ স্বাধীনের ৪ বছর পর ৭/১২/১৯৭৫ ইং তারিখে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

প্রসঙ্গত, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য এবং সরকার অনুমোদিত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই করেই ভাতাপ্রাপ্ত সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গত অক্টোবরে সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করে। নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় লাল মুক্তিবার্তা, ‘ভারতীয় তালিকা’ ও ‘গেজেট’। যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে যুক্ত হয়েছে, তাঁদের কোনো তথ্য ভূল থাকলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তা সংশোধন করার সুযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া কোনো ভূলের কারণে ভাতা থেকে কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ পড়লে তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে আবেদন করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ১৭/০৭/২০১৪ তারিখে প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার একমাত্র কন্যা লক্ষ্মী বড়ুয়া অনলাইন জিডি উএ ১৭৯৮৭১ এ আবেদন করেও তথাপি তার নামটি ওই তালিকায় তালিকাভুক্ত করা হয়নি। পরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কর্তৃক আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের মতবিনিময় সভায় লক্ষ্মী বড়ুয়া তার বাবার সম্পূর্ণ ডকুমেন্ট সম্বলিত একটি ফাইলসহ উত্থাপন করলে ঐ সভায় উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধারা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোদ্ধা হিসেবে সাক্ষ্য দেন।

প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার প্রসঙ্গে সাবেক চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম চিশতী বলেন, এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকার নাম ও পরিবর্তন সম্পন্ন জামুকার হাতে। যখন সুযোগ ছিল তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করলে হয়তো নাম সংশোধন করে তালিকায় আনার চেষ্টা করতাম। এরপরও আমি এই বিষয়ে প্রিয়দর্শীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করব এবং আমার নিজ অবস্থান থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আতাউল গণি ওসমানী বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নাম ও পরিবর্তনের ব্যাপারে একটা সময় নির্বাহী অফিসারদের হাতে ছিল, এখন আমাদের হাতে সেই অথোরিটি নেই। তবে তারা যদি চায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)র সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, জামুকাতে আবেদন করলে সরাসরি ওখান থেকে তালিকা লিপিবদ্ধ করা যাবে।

এ প্রসঙ্গে প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত রঞ্জন মজুমদার বলেন, রাঙ্গুনিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার চারটি গ্রুপে মধ্যে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, প্রিয়দর্শী দক্ষিণাঞ্চলের গ্রুপটিতে অন্যান্যর মধ্যে সেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রিয়দর্শী আমাদের সাথে ভারত ট্রেনিংয়ে প্রথম থেকে আগরতলা, দেমাগগিরি ও বগাপাহাড় থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীনের অবদান রেখেছিল। এখনো মনে আছে, পারুয়া ইউনিয়নের মানিক পালের মাটির ঘরের দ্বিতীয় তলায় প্রিয়দর্শীসহ আমরা ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রায় সময় বিভিন্ন শলা পরামর্শের জন্য একত্রিত হতাম।

তিনি আরো বলেন, ঢাকায় আহমদ চৌধুরী দুইটি তালিকা প্রণয়ন করে, একটি লাল ও অপরটি সাদা, লাল তালিকা হচ্ছে সশস্ত্র এবং জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বিক্রমের খেতাব অর্জন করেছিল তাদের নাম। ততমধ্যে প্রিয়দর্শী এই লাল তালিকায় আমাদের সাথে নাম ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলতে হয় প্রিয়দর্শী বড়ুয়া বা তার পরিবার এখনো পর্যন্ত সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া কোন সুযোগ সুবিধা ও প্রণোদনা পাইনি। আমি আশা করব সরকারি মুক্তিযোদ্ধার তালিকাতে তার নাম লিপিবদ্ধ করে অতিসত্বে তার পরিবারকে প্রণোদানের আওতায় আনবে।

প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার প্রসঙ্গে তার আরেক সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রণথ বরন বড়ুয়া বলেন, তার সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের আগ থেকে আমরা পূর্ব পরিচিত। তবে যুদ্ধের সময় প্রিয়দর্শী আমাদের দুই ব্যাচ পরে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং এ আসেন। প্রথমদিকে ট্রেনিং নেওয়ার সময় তৎকালীন আর্মি ট্রেনিং নেওয়াতে স্বীকৃতি প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিংয়ে আমার নাম আসেনি, তাই আমি দ্বিতীয় দফা ট্রেনিং নেওয়ার সময় প্রিয়দর্শী সাথে ট্রেনিং করি। সে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। নামের ভূলের কারণে যদি তার জীবদশা ও মৃত্যুর পরে তার পরিবারের করুণ অবস্থা হয়, সরকার তার পরিবারের পাশে না দাঁড়ায়, তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লাল-সবুজের পতাকা এনে দিয়ে তারা কি ভুল করেছিল? সরকারের কাছে আকুল আবেদন থাকবে প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার নাম সংশোধন করে তার পরিবারকে অন্তত সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় এনে দেশের সূর্য সন্তানদের পরিবারকে যথাযত সম্মান দেওয়া হোক।

অন্যদিকে প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার প্রসঙ্গে তার আরেক সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিৎ তালুকদার বলেন, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া একসাথে দেমাগগিরিতে ট্রেনিং শেষে খোদাবক্সের সাথে বাংলাদেশে আসি তখন থেকে শেষ পর্যন্ত প্রিয়দর্শীসহ আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছিলাম। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এরকম একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধার নামের ভূলের কারণে তার পরিবার সরকারি কোন রকম সম্মাননা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তার পরিবারের এই করুন অবস্থায় যদি সরকার পাশে দাঁড়ায় অন্তত তার বিদেহিআত্মা শান্তি পাবে।

পারুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখতিয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার জানামতে প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার পরিবার থেকে বেশ কয়েকবার প্রত্যয়ন পত্র ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আবেদন করার জন্য সহযোগিতা করেছিলাম আমি এবং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় নামটি পরিবর্তন হয়নি। এই এলাকারই একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত স্বপন বড়ুয়া অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, তারা দুজনে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিলেন। নাম সংশোধন জটিলতার কারণে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় প্রিয়দর্শী বড়ুয়ার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। এমন কি তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণে তার পরিবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়াও আমাদের পারুয়া ইউনিয়নের অরজিনাল মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আরো ৫, ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি।

পারুয়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আমিনুর রহমান বলেন, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া প্রকৃত একজনকে মুক্তিযোদ্ধা এটার কোন ভূল নেই। আমার ৬৫ বছর বয়সে তার সাথে অনেক ওঠা বসা ছিল এবং সে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সেটার সাক্ষী আমি নিজেই। স্বপন বড়ুয়া ও প্রিয়দর্শী বড়ুয়া এই দুইজন আমাদের এলাকায় চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধা।

পারুয়া ইউনিয়নের দফাদার মোঃ আবুল হোসেন বলেন, ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অন্যান্যদের সাথে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে স্বক্রীয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। তাই তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তখন আমার বয়স ১০ বছর। স্মৃতিচারণে মনে পড়ে আমার বাবা তৎকালীন গ্রাম পুলিশ ছিল সেই সুবাদে আমার দায়িত্ব ছিল মানিক পালের মাটির ঘরের দুতালায় ৭১ এর রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, রসদ সরবরাহ করা। তখন ঐ ঘরে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া সাথে আমিন শরীফ, আহমদ খান, প্রণব বরণ বড়ুয়া, স্বপন বড়ুয়া, চিত্তরঞ্জন মজুমদার ও প্রসেনজিৎ তালুকদার সহ আরো অনেকেই যুদ্ধকেন্দ্রীক বিভিন্ন শলা-পরামর্শের জন্য একত্রিত হইতো।

মুবিন বিন সোলাইমান