চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে দুটি মামলাতেই জামিন দিয়েছে গাজীপুরের আদালত। শনিবার দুপুরে ওমরাহ শেষে দেশে ফেরার পর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। জিএমপি’র বাসন থানায় দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং চাঁদাবাজি ও ভাংচুরের দু’টি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গ্রেফতারকৃত মাহিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭দিনের রিমান্ড চেয়ে গাজীপুরের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। বিকেলে শুনানী শেষে আদালতের বিচারক উভয় মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন।

জিএমপি’র সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) মো. আসাদুজ্জামান জানান, চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহিকে শনিবার বেলা পৌণে ১২ টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং জমি জবর দখল, চাঁদাবাজি ও ভাংচুরের অভিযোগ দায়ের করা পৃথক দুইটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত মাহিকে দুপুরে ৭দিনের রিমান্ড চেয়ে গাজীপুরের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে গ্রেফতারকৃত মাহিকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর বিকেলে মামলা দু’টির জামিনের শুনানী শেষে আদালতের বিচারক মো: ইকবাল হোসেন উভয় মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন।

পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে অপমান অপদস্ত ও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা, বানোয়াট, আক্রমনাতœক, কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকর তথ্য প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা অবনতির ঘটানোর অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (আইসিটি) বাসন থানার এসআই রোকন মিয়া বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে চাঁদাবাজি ও ভাংচুরের অভিযোগে ওই পৃথক মামলা দুইটি দায়ের করেন। শুক্রবার রাতে জিএমপি’র বাসন থানায় ওই মামলা দু’টি দায়ের করা হয়।

তিনি জানান, বাসন থানাধীন দিঘীরচালা এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেনের কোটি টাকা মূল্যের জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় মাহিয়া মাহি ও তার স্বামী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাকিব সরকারকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় পুলিশ আরো ৯ জনকে শনিবার ভোর রাতে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন- বাসন থানার তেলিপাড়া এলাকার মোতালিব হোসেনের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সোহাগ (৩৮), পালের পাড়া এলাকার রজব আলীর ছেলে আশিকুর রহমান (৩২), বাড়ীয়ালী এলাকার ইয়ার উদ্দিনের ছেলে ফাহিম হোসেন হৃদয় (২২), সদর থানার শিমুলতলী এলাকার আব্দুস সামাদের ছেলে জুয়েল রহমান (২৫), একই থানার নাগা এলাকার খালিদ সাইফুল্লাহ জুলহাস (৩০), গাছা থানার শরিফপুর এলাকার আবুল হোসেন মন্ডলের ছেলে সুজন মন্ডল (৩৪), টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার ইদারজানি গ্রামের আব্দুল জব্বারের ছেলে জমশের আলী (৪৪), চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সাতকানিয়া গ্রামের মৃত পেটাল আলীর ছেলে মোস্তাক আহমেদ (২২) ও নেত্রকোনার আটাপাড়া উপজেলার আড়াগাঁও গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে মাহবুব হাসান সাব্বির (১৮)। গ্রেফতারকৃতদের শনিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরো জানান, স্বামী রাকিব সরকারের সঙ্গে ওমরাহ পালন করেন মাহিয়া মাহি। ওমরাহ পালন শেষে শনিবার মাহিয়া মাহি বিমান যোগে দেশে ফিরেন। তাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে রাকিব সরকার দেশে না ফিরে পলাতক রয়েছেন।

জিএমপি কমিশনারের সংবাদ সম্মেলন ॥
এদিকে শনিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহী জমি সংক্রান্ত ঘটনায় পুলিশ বিভাগ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যাপারে ফেইসবুক লাইভে মিথ্যা মন্তব্য করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ও তার স্বামী রাকিব সরকার পুলিশ বিভাগ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, আক্রমাত্মক, মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন। একজন চলচ্চিত্র শিল্পীর নিকট থেকে এমন বক্তব্য আশা করি না। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চিত্র নায়িকা মিথ্যা বলে মানুষের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করেছেন তিনি। তারা পুলিশকে বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছেন। অথচ মাহী বা তার স্বামী জমিজমা সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসেননি। আজ যাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছেন, তাদেরও আমি চিনি না। পুলিশের ভাবমূর্তি ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (আইসিটি) তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জমি সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে তাদের প্রতিপক্ষের নিকট থেকে পুলিশ টাকা নিয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন এটা তারা কিভাবে বলতে পারেন ? এসময় তিনি জানান, মামলাগুলোর সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত করা হবে।

জিএমপি কমিশনার আরো বলেন, মাহিয়া মাহীর স্বামী রাকিব সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে অস্ত্র, হত্যা ও ধর্ষণের তিনটি মামলা রয়েছে। ওই মামলার ঘটনা সত্য ছিল, কিন্তুকেউ সাক্ষী দেয়নি। তবে এখন মামলাগুলো পুনরায় তদন্ত ও সাক্ষী প্রমাণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া রাকিব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। তার আরেক ভাই গাজীপুরের পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ও দখলের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। আমরা গাজীপুরবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহাসড়ক থেকে অননুমোদিত ও অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এতে সড়কে স্বাভাবিক গতি ফিরে এসেছে।

দুই মামলার এজাহারে যা আছে-
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে মাহিয়া মাহি ও রাকিব সরকার ফেসবুক আইডির মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে আইন-শৃঙ্খলার অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর জন্য অভিযুক্তরা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ উত্তর), অফিসার ইনচার্জ বাসন থানাসহ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত বিভিন্ন পদের কর্মকর্তাদের অপমান ও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিথ্যা, বানোয়াট, আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকর তথ্য প্রচার করেছে। মামলায় রাকিব সরকারকে এক নম্বর আসামি এবং মাহিয়া মাহি সরকারকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলাটি করেছেন বাসন থানার এসআই মো. রোকন মিয়া।

অপর মামলার বাদী মো. ইসমাইল হোসেন এজাহারে উল্লেখ করেছেন, বাসন থানার দিঘিরচালা এলাকার ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের পূর্ব পাশে তার (ইসমাইল) রড বাইন্ডিং কারখানা রয়েছে। দীর্ঘদিন তার নিকট আসামীরা চাঁদা দাবি করে আসছিল। কিন্তু তারা চাঁদা না পেয়ে শুক্রবার সৌদি আরবে থাকা রাকিব সরকার ও মাহিয়া মাহির নির্দেশে আসামীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। এতে তিন লক্ষ টাকার আসবাবপত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাদের হামলায় তিনি আহত হয়েছে। এ মামলায় মাহিয়া মাহি ও রাকিব সরকারকে হুকুমের আসামিসহ ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ১০/১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, স্বামীর সঙ্গে ওমরাহ পালন করতে যাওয়া ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়িকা মাহিয়া মাহি সৌদি আরবের মক্কা শহর থেকে শুক্রবার ভোরে তার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এসে তার স্বামী রাকিব সরকার সহ অভিযোগ করে বলেন, শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে স্থানীয় ইসমাইল হোসেন লাদেন ও মামুন সরকারের নেতৃত্বে তাদের মালিকানাধীন সনিরাজ কার প্যালেস শো রুমে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা শো-রুমের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা জানালার কাঁচ, চেয়ার, টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাংচুর এবং শো রুমের সাইনবোর্ড খুলে নেয়। এসময় তারা অফিস কক্ষ তছনছ করে ও টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রকিব সরকারের লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। ওই পেজ থেকে তার স্বামী রাকিব সরকার পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় দেড়কোটি ঘুষের বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে জমি দখল করে দেয়ার অভিযোগ করেন।

তারা অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ ভ’য়া-জাল কাগজ তৈরী করে রাকিব সরকারের মালিকানাধীন জমি জবর দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ জমি পাইয়ে দেয়ার জন্য জিএমপি কমিশনার এক কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ সময় মাহিয়া মাহি দম্পতি ওরমা পালনের জন্য সৌদি অবস্থান করছিল।

এদিকে মাহীর ফেসবুক লাইভের পর বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন, রকিব সরকার তার প্রায় সোয়া ১১ শতাংশ জমি দখল করে গাড়ির শো রুম করেছেন। সিএস থেকে হালনাগাদ পর্যন্ত কাগজ পত্র যাচাই করে ওই জমিটি আমি ক্রয় করি। রাকিব সরকার জমিটি জোর করে দখল করে রেখেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তিনি জমি উদ্ধার ও তাদের নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য অভিযোগ দিয়েছি। বিষয়টি মীমাংসার জন্য দফায় দফায় চেষ্টাও করা হয়। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ওই শো রুমে নতুন কিছু গাড়ি উঠাতে থাকে রকিব সরকারের লোকজন।

ইসমাইল বলেন, খবর পেয়ে সেখানে আমিসহ কয়েকজন হাজির হই। এসময় দেশীয় অস্ত্রসহ রাকিব সরকারের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায় ও মারধর করে। তারা নিজেরাই নিজেদের শো রুম ভাঙচুর করেছে। এ ঘটনায় আমিসহ কয়েকজন আহত হই। ওই জমি রাকিব সরকারের নয়।

তিনি আরও বলেন, জমি ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে রাকিব সরকার আমার কাছে এক কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। যেখানে এক কোটি টাকা দিলে সমস্যা সমাধান হয়, সেখানে আমি কেন পুলিশকে দেড় কোটি টাকা ঘূষ দেব? পুলিশ আমার পক্ষে থাকলে আজ কেন আমি মার খেলাম? কেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দিলাম? গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই রকিব তার স্ত্রী চিত্রনায়িকা মাহীকে ব্যবহার করছেন।