গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো মুখবিবরের যতœ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বলা হয়, মুখের স্বাস্থ্য সাধারণ স্বাস্থ্যের প্রতিচ্ছবি। মুখবিবরের স্বাস্থ্য বলতে মাঢ়ী, দাঁত ও দুই চোয়ালের অস্থির স্বাস্থ্যকে বুঝায়।এগুলোর স্বাস্থ্য ভালো হওয়া মানে-ই বলা যাবে ব্যক্তি যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মতে,‘ওরাল হেল্থ ইজ দ্য ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর ফর কোয়ালিটি অব লাইফ।’সে কারণে গর্ভকালীন মুখবিবরের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা একজন নারীর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে হরমোন বা প্রাণরসজনিত কতগুলো দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান পরিবর্তন আসে। এর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানসম্ভবা মায়ের মুখবিবরেও দেখা যায় দৃশ্যমান কতগুলো পরিবর্তন।যেমন:

১. প্রেগন্যান্সি জিনজিভাইটিস: খাবার গ্রহণের সময় খাদ্যকণাগুলো দাঁতের উপরে জমে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীবের সাহায্যে প্ল্যাক বা আস্তরণ তৈরি করে। দাঁতের চারপাশের মাঢ়ীর উপর এই ক্ষতিকর অণুজীবগুলোর ক্রিয়ার কারণে শরীরে এক ধরনের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়; যা সাধারণ অবস্থার চেয়ে গর্ভাবস্থায় বেশি হয়। এর ফলে মাঢ়ী ফুলে ওঠে এবং সামান্য আঘাতে রক্ত পড়ে। সাধারণত তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যাদের গর্ভাবস্থার পূর্বেকখনো এধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। তবে এতে খুব বেশি দুশ্চিান্তার ব্যাপার নেই। নিয়মিত এক কাপ কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ পরিমাণ খাবার লবণ নিয়ে দিনে কয়েকবার কুলকুচি করলে গর্ভবতী মা এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তাছাড়া অনেকক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের পর আপনা-আপনি এ সমস্যা ভালো হয়ে যায়।

২. প্রেগন্যান্সি ইপুলিস বা পাইয়োজেনিক গ্রানুলোমা: গর্ভাবস্থায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জনের মাঢ়ীতে এক ধরনের মসৃণ লাল বর্ণের গুটি দেখা যায়। এ গুটি সচরাচর মুখেরসামনের অংশের মাঢ়ীতে বেশি হয়ে থাকে। এতেসামান্য আঘাতে অধিক রক্তক্ষরণ ঘটে। দাঁত ও মাঢ়ীরঅনিয়মিত পরিস্কার করার কারণে মাঢ়ীর উপর জমে থাকা অণুজীবের প্রতি শারীরিকপ্রতিক্রিয়ার কারণে এটা হয়। সাধারণত সন্তান প্রসবের পর এটা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা, রক্তক্ষরণ, খাবার চিবাতে অসুবিধা হলে মুখ ও দন্তরোগবিশেষজ্ঞেরশরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসা নেওয়া যায়।

৩. দন্তক্ষয়: গর্ভাবস্থায় পাকস্থলিতে অম্লের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গর্ভবতী মায়ের বেশি বেশি বমি হয়। এতে অতিরিক্ত অম্ল মুখবিবরে উঠে আসে। এর ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়। ধীরে ধীরে দন্তক্ষয়জনিত কারণে দাঁত শিরশির করা এবং দন্তমজ্জার প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এক চা চামচ বেকিং সোডা এক কাপ পানিতে দিয়ে নিয়মিত কুলকুচি করে মুখবিবর পরিস্কার রাখলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৪. দাঁত নড়বড় হওয়া: গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন হরমোনজনিত পরিবর্তন সাধিত হওয়ার কারণে অনেকের এই সমস্যা দেখা যায়, তবে এতে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সন্তান প্রসবের পর এ সমস্যা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়।

একটি সুস্বাস্থ্যবান সন্তান জন্ম দেয়া প্রতিটি মায়ের একান্ত কাম্য। সে-কারণে মায়ের মুখবিবরের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান হওয়া অবশ্য কর্তব্য। একটু বে-খেয়ালে মায়ের লালারসের মাধ্যমে স্ট্রেপটোকক্কাস মিউট্যান্সের মতো ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ ঘটতে পারে সন্তানের শরীরে। এতে নষ্ট হতে পারে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। তাই সকালে নাস্তার পর এবং রাতে শুতে যাওয়ার আগে দিনে দুবার দাঁত মাজার পাশাপাশি দিনে একবার ফ্লসিং করা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু দাঁত মেজে আর ফ্লসিং করে মুখবিবর পরিস্কারের ব্যাপারে মনোযোগী হলে-ই হয় না, পাশাপাশি গর্ভকালীন মাকে সর্তক থাকবে হবে খাবার গ্রহণের ব্যাপারেও। এ সময় অতিরিক্ত চিনিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ ও ড্রিংকস পান করা থেকে বিরত থাকা দরকার। তবে-ই নিরাপদ হবে মায়ের মুখবিবরের স্বাস্থ্য, নিরাপদ হবে গর্ভকাল।

ডা. মো. সিকান্দার আবু জাফর
সহকারী তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।