জোনাকির মুখ গোমরা। দেখলে মনে হবে রাজ্যের সকল অন্ধকার বুঝি তার কপালের ভাজে এসে স্থান নিয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে কী একটা রাগ। অথচ জোনাকি যখন হাসে তখন মুক্তা ঝরে। না, মুক্তা ঝড়ে না, আলো ছড়িয়ে পড়ে। লেবুর ঝোপে জোনাকি পোকা যেমন নীলাভ শীতল আলো ছড়ায়। জোনাকি তার মায়ের উপর রাগ করেছে। করবে না! মা-ই তো সকল অশান্তির গোড়া। তা না হলে এমন নাম রাখতে যাবে কেন! জোনাকির সহপাঠীদের কত সুন্দর সুন্দর সব নাম। মিতালী, কুহেলি, অনিকা, মৌমিতা। নামের কী আর অভাব ছিল দুনিয়া জুড়ে। তাছাড়া এখন শিশুদের সুন্দর নামের বই পাওয়া যায় দোকানে। মা কি-না তার নাম রেখেছে জোনাকি। কেমন একটা পুরনো দিনের গন্ধ। গেঁয়ু গেঁয়ু ছোঁয়া লাগে শুনতে।
“কী হয়েছে সোনামণি! রিক্সায় ওঠো।”
“না, আমি যাব না, আমি যাব না তোমার সাথে।” – স্কুল ব্যাগটা কাধ থেকে ছুড়ে মারার মত ভঙ্গিতে মায়ের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল সে। “আমি যাব না তোমার সাথে। তুমি একটা পঁচা।”
“ছিঃ, রাগ করে না লক্ষী সোনা। রাগলে তোমায় হুতুম প্যাঁচার মতো লাগে।”
মায়ের সাথে রিকশায় চড়ে বসল জোনাকি। মা প্রতিদিন তাকে স্কুলে নিয়ে আসে, স্কুল ছুটি শেষে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। রিকশায় উঠে বসেই শুরু হয় রাজ্যের প্রশ্ন। “মা, এটা কেন হল? ওটা কেন হলো? মা! এটা কেন হলো না? ওটা কেন হলো না?”- ওরে বাপরে! কত কৌতুহল! মা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বিরক্ত। তবে আজ জোনাকি মায়ের কাছে কিছুই জানতে চাইবে না। মায়ের সাথে কথাই বলবে না। মাকে বুঝাতে হবে যে সে রাগ করেছে। রাগ করবেই তো! সহপাঠীরা যদি নাম নিয়ে ভেংচি কাটে, ছড়া বানায়, তবে কার রাগ না উঠবে বলো!
নিনিতা, নিলয়, রোদেলারা গলায় গলায় সুর মিলিয়ে বলেছে-
“জোনাকি ও জোনাকি
লেবু গাছ চিনো কি?
বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি কিনো কি?”
বাসায় ফেরার সারাটা রাস্তা জোনাকি মুখ গোমরা করে রেখেছে। একটিবারের জন্যও মায়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাইনি। মা আড় চোখে মেয়ের অভিমান দেখে চুপি চুপি এসেছেন।
খাবার টেবিলে জোনাকির উৎসাহ নেই। চঞ্চলতাও নেই অন্যদিনের মতো। অথচ খাবার টেবিলে বসেই জোনাকির বাংলা, ইংরেজি ক্লাসের হোমওয়ার্ক আশি-শতাংশ তৈরি হয়ে যায়। ভাত ইংরেজি রাইস, মাছ ইংরেজি ফিশ, শাকসবজি ইংরেজি ভেজিটেবল। চেয়ার অর্থ কেদারা, টেবিল অর্থ চৌপায়া, কাপ মানে পেয়ালা।
দুপুর বেলায় খাবার দাবার শেষে বিশ্রাম নেওয়ার নিয়ম। মায়ের সাথে শুয়ে ছিল জোনাকি। তবে মা যেদিকে শুয়েছেন, তার বিপরীত দিকে পাশ ফিরে।
মা বললেন- “চলো আমরা খেলায় খেলায় ছড়ার ক্লাসের হোমওয়ার্কটা শিখে ফেলি, আয়রে আয় টিয়ে/ নায়ে বড়া দিয়ে।”
“না, আমি ছড়া শিখব না। বলবো না তোমার সাথে সাথে।” – নড়েচড়ে বালিশের মাঝে মুখ গুঁজতে গুঁজতে বলল জোনাকি।
“লক্ষ¥ী মা আমার, এমন কথা বলে না। লিটন স্যারকে তো চিনই। ভীষণ রাগী মানুষ। অনেক লজ্জা দেবেন। আমার মেয়ে পড়া শিখেনি, আমারও লজ্জা হবে।”
“তোমার লজ্জা হলে হোক। আমি আর স্কুলে যাব না। ওরা আমাকে অপমান করে কেন? ওরা আমাকে নিয়ে ছড়া কাটে। বলে – ‘জোনাকি ও জোনাকি / লেবু গাছ চিনো কি? / বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি কিনো কি?’ আমার বুঝি লজ্জা লাগে না! আমি আর স্কুলেই যাব না। তুমি আমার এমন নাম রেখেছিলে কেন?”
“ওমা! ওদের কথা শুনে তোমার রাগতে হয় কি জন্য! তুমি কি জানো না তোমার রাগ দেখে ওরা তোমাকে আরো বেশি রাগাতে চেষ্টা করে। তুমি যদি রাগ না করো, তবে দেখবে ওরা ঠিকই তোমাকে এসব বলা ছেড়ে দেবে।”
“কিন্তু তুমি একটা পঁচা মা। তুমি আমার এমন নাম রেখেছিলে কেনো?”
“শুনতে চাও কেন রেখেছিলাম। শুনো তবে – তখন তুমি আমার পেটে। পেটের ভেতর ডিগবাজি খাও। একদিন পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলাম। খাতার উপর টপ করে একটা শব্দ হলো। দেখলাম একটা জোনাকি পোকা। মাকড়সার জালে আটকা পড়েছিলো হয়তো। মাকড়সা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সারা শরীরে শক্ত জাল দিয়ে বেধে ফেলেছিল তাকে। কিন্তু পারেনি। জোনাকি পোকাটার পেটের নিচে আলো তথনও জ¦লছে আর নিভছে। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল জোনাকি পোকাটাকে আমার বাঁচাতেই হবে।”
এবার কিন্তু মেয়ের কৌতুহল বেড়ে গেছে। মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বল্ল সে – “তারপর কী হলো মা?”
“আলতো ভাবে ধরলাম তাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল বোধ হয়। তাই মুখ থেকে জালের কিছু অংশ ছিড়ে ফেললাম প্রথমে। তারপর একটা কাঠি দিয়ে সারা শরীরের জালগুলো। জাল ছিঁড়তে গিয়ে অবশ্য জোনাকি পোকাটার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু প্রানে বেঁচে ছিল। একটা বিপদগ্রস্থ মুমূর্ষূ প্রণীকে বাচিয়ে দেওয়া কি যে আনন্দেও, তুমি যদি জানতে! জোনাকি পোকাটা মুক্তি পেয়ে কী করলো জানো?”
“কী করলো মা?” – কৌতুহলী চোখ নিয়ে মেয়েটা বলল।
“আমার হাতের আঙ্গুলগুলোতে হাঁটতে শুরু করলো। তারপর হাতে, তারপর সারা শরীরে। শিশু-বাচ্চারা যেমন উঠান জোরে হামাগুড়ি দেয়, ঠিক তেমনি। পাখা ঝাপটে উড়তেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওর গায়ে তখন তেমন শক্তি ছিল না। আমরা কেমন যেন একটা আত্মতৃপ্তি লাগছিল। আমি ওকে বাঁচিয়েছি। আমি ওকে নতুন প্রাণ দিয়েছি। একটা মুমূর্ষ প্রাণীকে বাঁচিয়ে দেওয়া যে কত আনন্দের। ঠিক সে মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি ওকে নতুন জীবন দিয়েছি, ও আমার সন্তান। ও আমার উদারজাত সন্তান। ঠিক করেছিলাম আমার যদি মেয়ে হয় তবে তার নাম রাখব জোনাকি।”
মায়ের প্রতি মেয়ের রাগ কিছুটা কমেছে এবার।
“কিন্তু মা, ওরা যে আমার নাম নিয়ে ভেংচি কাটে। আমার গায়ের রক্ত গরম করে দেয়।”
“লক্ষী মেয়ে। তুমি রেগে যাও কেন! তোমার রাগ দেখলে ওরা তোমাকে আরো বেশি রাগাতে চেষ্টা করে।”
মা মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। জোনাকি মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকালো। জোনাকি এবার ঘুমিয়ে গেছে। নাহ… ঘুমায়নি, তোন্দ্রার ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। একটা জোনাকি পোকা যেন তাকে ডেকে ডেকে বলছে – “জোনাকি ও জোনাকি। তুমি আমাকে চেনো? আমি জোনাকি পোকা। আমি তোমার খেলার সাথী, স্কুলের সহপাঠী। আমি তোমার ভাই, মায়ের পেটের ভাই। তুমি রেগে যাও কেন? তোমার রাগ দেখে ওরা তোমাকে আরও বেশি রাগাতে চেষ্টা করে।”