ইতিকাফ শব্দের অর্থ হল নিজেকে আটকে রাখা, মগ্ন থাকা, কোন জিনিসকে আকঁড়ে ধরা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় বলা হয় “ একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মসজিদে অবস্থান করা। ইতিকাফ একটি ফজিলতপূর্ণ আমল ও মহা অনুগত্য প্রদর্শন। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “নবী করিম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু অবধি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তারপর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন”। (বুখারী)

ইতিকাফের বিধান আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে চালু ছিল। আল্লাহ তায়াল বলেন “ আর আমি ইব্রাহিম ও ইসমাঈল (আঃ) কে অঙ্গীকারবদ্ধ করলাম যে, তোমরা উভয়ে আমার কাবা গৃহকে তাওয়াফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো”- সূরা বাকারাহ -১২৫।

ইতিকাফ সকল সময়ের জন্য সুন্নাত, তবে উত্তম হলো রমজানের শেষ দশকে করা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদাই রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছনে।

ইতিকাফের শর্ত তিনটি-

১. নিয়্যাত করা: ইতিকাফকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের জন্য মসজিদে অবস্থান করবেন এমন সংকল্প করা। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন-“প্রত্যেক কাজ নিয়্যাতের উপর নির্ভশীল”।

২. এমন মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে জামাতে ও সাথে নামায পড়া হয়। মসজিদ ব্যাতিত অন্য কোন জায়গায় ইতিকাফ করা বৈধ নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করা অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করিও না”- (সুরা বাকারাহ-১৮৭) নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা মসজিদে ইতিকাফ করতেন। কেননা যেই মসজিদে জামাতের সাথে নামায পড়া হয় না সেখানে জামাত ছুটে যাওয়া আশংকা থাকে অথচ জামাতে নামাজ ওয়াজিব। আর বার বার ইতিকাফকারী ব্যক্তির বাইরে যাওয়া ইতিকাফের উদ্দেশ্যর সাথে সাংঘর্ষিক। তবে মহিলাদেও জন্য মসজিদে জামাত হউক বা না হউক এমন যায়গায় ইতিকাফ করা বৈধ। যখন তার ইতিকাফ দ্বারা ফেতনার আশংকা থাকবে না। যদি ফেতনার আশংকা থাকে তবে মহিলাদেও জন্য ইতিকাফ করা বৈধ হবে না । উত্তম হচ্ছে এমন মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে জুমআর নামাজ হয়। তবে তা ইতিকাফের জন্য শর্ত নয়।

৩. নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়া । গোসল এমন ব্যাক্তির জন্য ইতিকাফ করা বৈধ হবে না। হায়েজ ও নেফাস অবস্থায় মহিলাদের ইতিকাফ করা বৈধ নয়।

ইতিকাফের জন্য রোযা পালন করা শর্ত নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর হতে বর্ণিত যে, ওমর (রাঃ) নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমি জাহেলী যগে মসজিদে হারামে একরাত ইতিকাফ করার নিয়্যাত করেছিলাম ’ তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন “তোমার নযর পূরণ কর” – (বোখারী)। যদি ইতিকাফের জন্য রোযা শর্ত থাকত রাতে ইতিকাফ করা শুদ্ধ হত না। আরও প্রমাণ কওে ওয, রাসূল সাল্লালাহু সাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম শাওয়াল মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছেন- (মুসলিম)।
যে কোন দিন যে কোন মুহুর্তের জন্য ইতিকাফ করা বৈধ। তবে উত্তম হলো একদিন বা একরাতের কম ইতিকাফ না করা। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সবচেয়ে উত্তম সময় । নবী করীম সাল্লালাহু সাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম হতে প্রমাণিত যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন – “নবী করিম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু অবধি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তারপর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন”- (বুখারী)।

যে ব্যাক্তি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার নিয়্যাত করবে সে একুশ রমজান ফজর নামাজ পড়ে যে মসজিদে ইতিকাফ করবে সেখানে প্রবেশ করবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “ রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু সাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজানে ইতিকাফ করতেন, তিনি ফজর নামাজ পড়ে ইতিকাফের স্থানে প্রবেশ করতেন” – (বোখারী)। ইতিকাফ শেষ হবে রমজানের শেষ দিন সূর্য অস্ত যাবার দ্বারা। তবে উত্তম হল ঈদের দিন সকাল বেলা বের হওয়া। যা বহু সালফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত। ইতিকাফের হিকমাহ্ হল পার্থিব প্রয়োজন, পারিবারিক ব্যাস্ততা থেকে নিজেকে মুক্ত থেকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে মগ্ন করা। এ জন্য ইতিকাফকারী ব্যাক্তির অন্তর সকল দুয়াবি চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যকীয়।

ইতিকাফকারী ব্যাক্তির জন্য যা বৈধ-

১. অতীব প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া, যেমন খানা-পিনার জন্য বের হওয়া যদি মসজিদে খাবার পৌছেঁ দেওয়ার মত লোক না থাকে। অথবা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সাড়ার জন্য বের হওয়া। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন “ নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফ রত অবস্থায় তার মাথাকে আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেন আমি চিরুণী করে দিতাম। এবং তিনি মানুষের জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে প্রবেশ করতেন না- (মুসলিম)।
২. চুল আচঁড়ানো।
৩. উপকারী বিষয়ে মানুষের সাথে কথা বলা, তাদের অবস্থার খোঁজ-খবর নেওয়া তবে এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত না করা, কেনান ই’তিকাফের উদ্দেশ্যর সাথে সাংঘর্ষিক।
৪. পরিবারের লোকজন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে।
ইতিকাফ কারী ব্যাক্তির জন্য যা বৈধ নয়- ১. বিনা প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত মসজিদের বাহিরে যাওয়া যদিও অল্প সময়ের জন্য হয়।
২. স¦ামী- স্ত্রী সম্পর্ক স্থাপন করা।
৩. রোগীর সেবা করা ও জানাযার সালাতে অংশগ্রহণ করা।

আজকাল কোন কোন মসজিদে দেখা যায় ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদিম বা মসজিদ কমিটির লোকজন, এমনকি স্থানীয় মুসল্লিদেও কেউই ইতিকাফ করছেন না । বরং বাইওে থেকে ভাড়াঠে কাউকে এনে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে ইতিকাফ করান। এতে ইতিকাফের লক্ষ্য অর্জন হয় না। ইতিকাফ অবস্থায় ইতিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে কোন নফল ইবাদত না করলেও ইতিকাফের সাওয়াব পাবেন। তবে অতিরিক্ত নফল ইবাদত করলে আরও বেশি ফজিলতের অধিকারী হবেন। যেমন: কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা, নফল নামাজ পড়া, দোয়া-দরুদ পাঠ করা, জিকির আযকার করা, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা। এ ছাড়া দ্বীনি কথাবার্তা ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা করাও সাওয়াবের কাজ। যেমন : কোরআন হাদীস, হাদিস ফিকাহ, তাফসীর ইত্যাদি পাঠ করা ও তালিম করা।

ড. মোঃ হাবিবুল্লাহ, মুফাসসির, মদীনাতুল উলুম কামিল মাদরাসা, রাজশাহী।