গাম্ভীর্যে ভরপুর। তুলনাহীন সৌন্দর্যে শোভিত। সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটা বন। নাম তার মতিহার উদ্যান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ঠিক পেছনে ও বিশ্ববিদ্যালয় সীমানার দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেঁষে অবস্থিত এ সবুজ কন্যার রাজসভা।

জনমানবশূন্য এ প্রাঙ্গণ প্রাণিকুলের মহারাজত্ব স্থলও বটে। পাখিদের ঘুমভাঙানি গানের সুরে নিত্য ঘুম ভাঙে মহারানির। শালিক পাখির চিকন সুরে সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া গানে রানি ঘুম থেকে উঠছে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই বোধ হয় শালিকের গান ভোর সকালে উচ্চস্বরেই শোনা যায়। রানির ঘুম ভেঙেছে প্রজাদের কি ঘুমানো শোভা পায়? তা বটেই না। তাই তোড়জোড় করে সবাই উঠে শুরু করে সাজসজ্জা। প্রজাদের আনাগোনা মুখরিত হয় পুরো রাজ্য।

হঠাৎ করেই সূয্যি মামা উঁকি দেন রানির উঠানে। অতন্দ্র প্রহরী তরুগুলো সারারাত ধরে গচ্ছিত শিশির কণা ঢেলে দেন মামার আগমনে। সেই স্নিগ্ধ-স্বচ্ছ পানিতে স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন মহারানি।

সূয্যি মামার সোনালি আলোতে রাজ্যের যত অপবিত্র-জরাজীর্ণতার পরিসমাপ্তি ঘটে। শীতের হালকা বাতাস আর মিষ্টি রোদের আলোয় তরুরাজির ডানাগুলো দুলতে শুরু করে। মাঝেমাঝেই নতুন ডানা গজানোর জন্য পুরাতন ডানাগুলো নিজেদের অবস্থান বিসর্জন দিয়ে তাদের খুশিতেই হেসে বিদায় নেয় আর বলে মুবারক নবযাত্রা ভালো থেকো তোমরাও, ছেড়ে দিও নবাগতদের নতুনত্বকে বরণ করতে।

রানির প্রজাকুলের মধ্যে সদস্যের সারি ভারি করে আরো দাঁড়িয়ে আছে, সুউচ্চ গগণ শিরীষ বা রেইন ট্রি গাছ, ঘন বাঁশঝাড়, মেহগনিগাছ, আমের বাগান, শালিক, দোয়েল, হলদে, ঘুঘু, ফিঙ্গি পাখি, উদ্যানের পুকুরে করে শুভ্র বক ও কৃষ্ণ পানকৌড়ি। গভীর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কোথায় আবার তুলা, কচু, মাশকালাই বুনা, বৃক্ষরাজি, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, বহেরা, আমলকি, শিরিষ, শিমুল, লটকন, মেহগনি, পলাশ, আকাশমণি, বন কাঠালি, তমাল, হিজল, কামরাঙা, আকন্দ, আম, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।

সদস্যদের সকলেই পাকস্থলীর পীড়া নিবারণে সাম্রাজ্যের এমাথা ওমাথা সদা ছোটাছুটিতে মাতোয়ারা। কেউ বা ছোট্ট বাচ্চাদের মুখে তুলে দিচ্ছে সামান্য অন্ন। আবার কেউ বাসা মেরামতের জন্য রসদ সংগ্রহে অধীর। এ যেন মহাব্যস্ত নগরী। এ নগরীতে যেন কোনো বেকার নেই আর না আছে কোনো ছোট-বড় কাজের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে হেয় করার ঘৃণিত প্রথা।

হঠাৎই তীব্র তাপদাহের পরিসমাপ্তি ঘটে। শেষ হয় যত ব্যস্ততা। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে কখনো আধাপেট আবার কখনো ভরা পেটে খুশির মহাপ্লাবনে ভাসতে ভাসতে হাজির হয় পাখিদের দল। তাদের পর একে একে হাজির হতে থাকে ছোটবড় পশু, পাখি থেকে শুরু করে কীটপতঙ্গসহ রাজ্যের সকল প্রজারা। অপরদিকে ছুটির আবেদনপত্রের সাথে দেখা মেলে শিয়াল পণ্ডিত মশায়ের। তিনি আবার রাতের নিস্তব্ধতা ছাড়া পণ্ডিতি করে আয়েশ পান না।

যাহোক, রাজ্যে শুরু হয় গল্প, গান, বাজনা, নাচ আর আড্ডার মহাআসর। বাজনা বাদক ঝিঁঝিঁ পোকা মশায় ঝাঝা কণ্ঠে তোলেন সুর। সাথে সাথে নিস্তব্ধ পুরো সাম্রাজ্য। ঘনকালো অন্ধকারের সাথে সাথে যেন রাজ্যসভার চোখ ধাঁধানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মুগ্ধতা প্রকাশ পায়। যত রাত গভীর হয় আড্ডা তত জমজমাট হয়। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আছে শুধু ঝাঝা আর নিস্তব্ধতার গুমট আওয়াজের নামহীন সুর।

নাচনীওয়ালী কচি কিশোলয়গুলো এলোপাতাড়ি নাচে বাধভাঙ্গা নিরব উচ্ছ্বাস। কিছু সময় পরেই রাজ্যের ছোট-বড় সকলে মিলে তালহীন নাচের প্লাবন বয়ে চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাদের যেন ক্লান্তি নেই, নেই কোনো সংসার চিন্তা কিংবা ধনকুবের মালিক হওয়ার বাসনায় সকল আয়েশ ত্যাগ করে গভীর ধ্যানে মগ্ব হয়ে মাথা হেট হওয়া। এ রাজ্যে কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই, নেই কাউকে মাড়িয়ে নিজেকে মহৎ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস। না আছে হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা অপরকে ধ্বংস করার ঘৃণিত রেওয়াজ।

তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হতো তোমরা এতো সুখি কেন? তোমাদের সমৃদ্ধির সিক্রেট কী? তারা অবশ্যই বলতো সুখের সন্ধান হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যতটুকু আছে তা নিয়েই সবার সাথে মিলেমিশে এক হয়ে থাকার নিমিত্তে। আর আমাদের সমৃদ্ধির সিক্রেট আমরা পিছনে ফিরে কখনো তাকায় না। আমরা নিজেদের দায়িত্ব কী তা খুঁজে বের করি এবং নিজেদের সবটুকু দিয়ে পালন করি।

এম. শামীম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়