রাজধানীর বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বা বৃষ্টি খাতুনের লাশ এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। তার লাশের পোস্টমর্টেম এবং পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এখনই তার লাশ হস্তান্তর করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে মর্গ কর্তৃপক্ষ। ডিএনএ পরিবারের সদস্যদের সাথে মিললেই হস্তান্তর করা হবে।

এদিকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। অভিশ্রুতি ও বৃষ্টি খাতুন নামে দুজন একই ব্যক্তি বলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এনআইডি সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে নিহত অভিশ্রুতি নামের ব্যক্তি বাস্তবে বৃষ্টি খাতুন। তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) সংশোধন চেয়ে আবেদন করেছেন। আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরিতে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এনআইডি সংশোধন আবেদনে জানা যায়, বর্তমান এনআইডি অনুযায়ী তার নাম আছে বৃষ্টি খাতুন, বাবার নাম সবুজ শেখ। এনআইডি সংশোধনে তিনি নিজের নাম বৃষ্টি খাতুন থেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ও বাবার নাম সবুজ শেখ থেকে মো: শাবরুল আলম এবং জন্মসাল ১৯৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সংশোধন চেয়েছেন। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী (বৃষ্টি খাতুন) গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজ নাম, বাবার নাম ও জন্মসাল পরিবর্তন চেয়ে আবেদন করেন।

জাতীয় পরিচয়পত্রে এসব তথ্য সংশোধনের জন্য ২০২২ সালের নিবন্ধন করা জন্মসনদ, বাবার এনআইডি, মায়ের এনআইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্ব সনদ দাখিল করেছেন। তবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী যে জন্মসনদ দিয়ে আবেদন করেছিলেন সেটি ভুয়া ছিল। সংশোধন আবেদনে দাখিলকৃত বাবা-মায়ের এনআইডি অনুযায়ী হাসপাতালে নিজের মেয়ে দাবি করা মো: শাবরুল আলম সঠিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

রোববার দুপুর ১২টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বনগ্রাম পশ্চিমপাড়া গ্রামে গেলে দেখা যায় সেখানে শোকের মাতম চলছে। বিলাপ করছেন মা বিউটি পারভীন। আর পাশে অঝরে পানি ঝরছে ছোট দুই বোন ঝর্ণা আর বর্ষার চোখে। নিকটাত্মীয় পাড়া-প্রতিবেশীরা তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে ঝর্ণার সাথে কথা হয়। প্রশ্ন করা হয়েছিল- বৃষ্টির নাম পরিচয় নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে বিষয়টি কী? অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তার জবাব- ‘বৃষ্টি আমার আদরের বড় বোন। এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কিইবা হতে পারে?’ প্রমাণ হিসেবে অনেক কিছুই উপস্থাপন করলেন তিনি। এসএসসি’র রেজিস্ট্রেশন কার্ড, এনআইডি’র ফটোকপি, ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার সনদ। তার সব কিছুতেই বৃষ্টি খাতুনের নাম রয়েছে। বাবার নাম সবুজ শেখ। ছোট বোন বর্ষা খাতুন বড় বোন বৃষ্টির সাথে তার নানা স্মৃতিময় তথ্য বলতে থাকেন। গোটা পাড়াই যেন শোকাচ্ছন আবহ।

গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে অনেকেই এগিয়ে আসেন। বৃষ্টির পরিচয় নিয়ে যা হচ্ছে তা ঠিক নয় দাবি তাদের। বৃষ্টির মায়ের সাথে কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কিছু বলার আগেই তিনি বলেন, বৃষ্টি আমার মেয়ে। সে অন্য কারো মেয়ে হতে পারে না। আমার বুক চিরে প্রয়োজনে পরীক্ষা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন মা। আমি তার কাছে আমার মেয়েকে ফেরত চাওয়ার আকুতি জানাচ্ছি। দয়া করে যেন আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।’

এভাবেই বেশ কিছু সময় বিলাপ করতে থাকেন তিনি। প্রতিবেশীদেরও একই কথা- রাজধানীয় ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সাংবাদিক আমাদেরই সন্তান।

বৃষ্টি প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন বনগ্রাম ব্র্যাক স্কুলে। ছয় বছর বয়সে তিনি ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি হন। ২০০৯ সালে সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এমনটিই জানান শিক্ষক মিলিয়া পারভীন।

জন্মের পর থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন চাচী শাহিদা পারভীন। তার কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানান বৃষ্টি অধিকাংশ সময় তার কাছে থাকত।

কথা হয় বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের সাথে। একই সাথে তিনি বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও। তিনি জানান, ‘রাজধানী ঢাকায় বেইলি রোডে একটি ভবনে যে আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেখানে মারা গেছেন আমাদের মেয়ে বৃষ্টি। গণমাধ্যমে তার নাম শোনা যাচ্ছে অভিশ্রুতি শাস্ত্রি। তার বাড়ি বনগ্রাম পশ্চিম পাড়ায়। বাবার নাম সবুজ শেখ। মা বিউটি বেগম। জন্ম নিবন্ধনও তার পরিষদ থেকেই নেয়া। এনআইডিও একই নামে। এনআইডি’র তথ্যমতে বৃষ্টির পুরো নাম বৃষ্টি খাতুন। জন্ম ১৯৯৮ সালের ৯ মার্চ। বাবার নাম সবুজ শেখ এবং মাতার নাম বিউটি বেগম। জাতীয় পরিচয়পত্র নং-৫১০৪৯৮০৬৮৪, ভোটার নাম্বার-৫০১১৮৫০০০১৬৬, ভোটার এরিয়া কোর্ড ৫০১১৮৫, সিরিয়ার নাম্বার-৩৬৪, ভোটার এলাকা-বনগ্রাম পশ্চিমপাড়া। এনআইডিতে লিঙ্গ পরিচয় অবিবাহিত, ধর্ম-ইসলাম, রক্তের গ্রুপ-(ও+), জন্মস্থান কুষ্টিয়া।’

চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম আরো জানান, ‘মাস তিনেক আগেও বৃষ্টির সাথে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় তার সাথে দেখা হয়। আমি তার সাথে ছবিও তুলি। যে ছবি আমার কাছে রয়েছে।’

বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আব্দুল মজিদ জানান, ‘বৃষ্টি আমাদের ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা। একই গ্রামে বাড়ি। সমাজ জামাতও একই সাথে করি আমরা। তিনি যে আমাদের এলাকার বাসিন্দা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা সবাই মুসলিম মুসলিম পরিবারেই তার জন্ম।

এদিকে, আইনি জটিলতায় বৃষ্টির লাশ ছাড় না পাওয়ায় মর্মাহত বৃষ্টির পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী। তারা দ্রুতই সকল জটিলতা কাটিয়ে তার লাশ ফেরত চান।

বৃষ্টির বাবা মেয়ের লাশ পাওয়ার চেষ্টায় অবস্থান করায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।