ভারতে এবারের সংসদীয় নির্বাচন শুরুর আগে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘আব কি বার চার শ’ পার’ – অর্থাৎ কি না বিজেপি জোট এবার চার শ’ আসন অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।

কিন্তু ভারতে সাত দফার নির্বাচনে চার দফার ভোটগ্রহণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন বিজেপি নেতারাও আর ‘চার শ’-র কথা ভুলেও মুখে আনছেন না, অন্য দিকে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে ‘দেখবেন, বিজেপির আসনসংখ্যা দু’ শ’রও নিচে নেমে আসবে!’

ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরাও মোটামুটি একমত যে প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে বিজেপি জোট এখনো অবশ্যই এগিয়ে – কিন্তু চার শ’ তো দূরস্থান, গত নির্বাচনে এককভাবে বিজেপি যে ৩০৩টি আসনে জিতেছিল, সেই পুরনো রেকর্ড ধরে রাখাও তাদের পক্ষে খুবই কঠিন।

এমন কি পার্লামেন্টে ‘সিম্পল মেজরিটি’ বা সাধারণ গরিষ্ঠতা পেতেও হয়তো তাদের বেগ পেতে হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।

ভারতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মোট ৫৪৩টি আসন, ফলে সাধারণ গরিষ্ঠতা পেতে হলে কোনো দল বা জোটের অন্তত ২৭২টি আসনে জেতাটা জরুরি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এই ‘ম্যাজিক নাম্বার’কে নিশানা করেই বিজেপি ‘মিশন ২৭২ প্লাসে’র টার্গেট রেখেছিল ও তা পূর্ণও হয়েছিল। ৪০ বছরের মধ্যে সেই প্রথম ভারতে কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে লোকসভায় গরিষ্ঠতা অর্জন করে।

নরেন্দ্র মোদির গত ১০ বছরের শাসনকাল, যেটাকে ভারতে ‘মোদি ডিকেড’ বলে ডাকা হচ্ছে, তারপর এবারের নির্বাচনে সেই লক্ষ্য পূরণে কোনো চ্যালেঞ্জ আসতে পারে- মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও বিজেপি নেতারা তা ভাবতেও পারেননি।

অনেকটা সেই কারণেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদি জোটের জন্য একেবারে ‘চার শ প্লাসে’র লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন, যাতে নিশানাটা অনেক উঁচু তারে বেঁধে ফেলা যায়।

কিন্তু চার দফায় দেশের ৭০ শতাংশেরও বেশি আসনে ভোট হয়ে যাওয়ার পর বিজেপি নেতাদের গলায় সেই আত্মবিশ্বাসী সুর আর শোনা যাচ্ছে না, অন্য দিকে রাহুল গান্ধী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা মমতা ব্যানার্জীর মতো বিরোধী নেতানেত্রীরা রোজই তাদের আক্রমণের সুর চড়াচ্ছেন। বিজেপি কোনোক্রমে দু’শ’ পেরোবে, বা দু’শ’রও নিচে নেমে যাবে তাদের আসন– এই জাতীয় হুঙ্কারও দিতে শুরু করেছেন তারা।

যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণের মতো রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট– যারা সরাসরি কোনো দলের সাথে যুক্ত নন– তারাও পূর্বাভাস করছেন, নির্বাচনি গতিপ্রকৃতি দেখে এখন মনে হচ্ছে বিজেপি জোটের পক্ষে গরিষ্ঠতা অর্জন করাই খুব মুশকিল। সুরজিৎ ভাল্লার মতো কোনো কোনো বিশ্লেষক আবার এই মতের শরিক নন– তারা এখনো মনে করেন বিজেপি খুব সহজেই জিতবে।

এরই মধ্যে গত সপ্তাহে ভারতের শেয়ার বাজারে যে আকস্মিক পতন লক্ষ্য করা গেছে, সেটাকেও অনেকে এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতিফলন বলেই ব্যাখ্যা করছেন।

শেয়ার বাজার সবচেয়ে ভয় পায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে। বিজেপি কোনো কারণে গরিষ্ঠতা না-পেলে তা বাজারে অস্থিরতা ডেকে আনবে, এই আশঙ্কা থেকেই বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বা ‘নিফটি’তে দরপতন হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অনেকে মনে করছেন।

এগুলোর অনেকটাই হয়তো জল্পনা বা তাত্ত্বিক আলোচনা, কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই – মাসদুয়েক আগে তফসিল ঘোষণার সময়ও যে নির্বাচনকে ‘ডান ডিল’ বা ‘ফলাফল তো জানাই’ বলে ভাবা হচ্ছিল – হঠাৎ করেই ভারতের সেই নির্বাচনটা যেন একেবারে ‘ওপেন’ হয়ে গেছে।

অর্থাৎ কিনা, এই নির্বাচনেও অবাক করার মতো ফল হতে পারে– এই কথাটা রাজনৈতিক পন্ডিত থেকে সাধারণ ভোটাররা অনেকেই এখন প্রবলভাবে বিশ্বাস করছেন।

কেন আর কিভাবে এমনটা ঘটল, তারই পাঁচটি নির্দিষ্ট কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

রামমন্দিরের আবেদন ম্লান?
গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যাতে ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত নতুন রামমন্দিরে প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন বিগ্রহের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করেন, সেরকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে।

দেশের শাসক দল বিজেপি তখন খুব গর্বের সাথে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় ছিল বলেই চার শ’ বছরের পুরনো একটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’-কে শুধরে নিয়ে হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রকে তার জন্মস্থলে সসম্মানে অধিষ্ঠিত করা গেল।

বস্তুত বহু বছর ধরে বিজেপির যে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা– কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপ, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা ও ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা – এর মধ্যে দিয়ে তার দু’টির কাজ শেষ হয়ে গেল, এটাও বলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল তারা।

রামমন্দিরের উদ্বোধনের পর দেশ জুড়ে যে হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগের জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, সম্ভবত তার জোরেই প্রধানমন্ত্রী মোদিও চার শ’ও বেশি আসনে জেতার পূর্বাভাস করেছিলেন।

কিন্তু সেই ঘটনার তিন-চার মাসের মাথায় এসেই দেখা যাচ্ছে, রামমন্দির কিন্তু দেশের নির্বাচনে সেভাবে আর সাড়া ফেলতে পারছে না।

ভোটের মাঝপথে প্রধানমন্ত্রী মোদি আবারো অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে মন্দির দর্শন করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

দিল্লিতে তরুণ গবেষক ও সাংবাদিক অয়নাংশ মৈত্রর মতে, রামমন্দিরকে আসলে বিজেপি ‘নির্বাচনি ইস্যু’তে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে– পাশাপাশি দেশের যে সব অংশ থেকে বিজেপি বাড়তি আসন জেতার আশা করছিল, সেখানেও তা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ভারতের বেশির ভাগ মানুষের কাছে রামমন্দিরের আবেদনটা বোধহয় আধ্যাত্মিক। মন্দির চালু হওয়ার পর অযোধ্যায় তীর্থযাত্রা বা পর্যটন বাড়াতে অর্থনীতি লাভবান হতে পারে, কিন্তু ভোটের বাক্সে তা বিশেষ ফারাক তৈরি করবে বলে মনে হয় না।

‘তাছাড়া রামমন্দিরের আবেদন প্রধানত উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চল বা গোবলয়েই সীমাবদ্ধ– যেখানে বিজেপি ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে জিতে বসে আছে।’

চার শ’র কাছাকাছি আসন পেতে হলে দক্ষিণ বা পূর্ব ভারতে বিজেপিকে আসন প্রচুর বাড়াতে হবে, কিন্তু সেখানে রামমন্দির তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই ধারণা অয়নাংশ মৈত্রর।

তিনি বলছিলেন, ‘লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলা-তামিল-মালয়লাম ভাষাভাষী হিন্দুদের মধ্যে কিন্তু রামচন্দ্র ছাড়াও ওই ভাষাগোষ্ঠীর নিজস্ব দেবদেবীর প্রতি একটা আলাদা আবেগ কাজ করে।’

‘দক্ষিণ ভারত যেমন মুরুগানকে নিয়ে, বাংলা শিবঠাকুর বা দেবী সরস্বতীকে নিয়েও বিহ্বল থাকে। সেই জায়গায় পূর্ব ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের নিম্নবিত্ত মানুষের সাথে অযোধ্যার দূরত্ব যোজন মাইলের!’

ফলে মন্দিরের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠার’ মাসচারেক পরে এসে ভারতের নির্বাচনি চালচিত্রে ইস্যু হিসেবে এটি ক্রমশ ম্লান হয়েছে– একইসাথে মন্দির ইস্যুতে ভর করে বিজেপির বাড়তি আসন জেতার স্বপ্নও নিশ্চিতভাবে হোঁচট খেয়েছে।

কেজরিওয়াল এফেক্ট
এই নির্বাচনের আগে ভারতে বিরোধীদের প্রধান অভিযোগ ছিল, সিবিআই বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের (ইডি) মতো কেন্দ্রীয় সরকারি এজেন্সিগুলোকে শীর্ষ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে বিজেপি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে।

নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই রাজ্যে রাজ্যে অজস্র বিরোধী নেতার বাড়িতে বা দফতরে এজেন্সিগুলো হানা দিয়েছে, অনেককে আটক করা হয়েছে– ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম প্রধান মুখ ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেন আজ পর্যন্ত জেলেই রয়েছেন।

তবে গত ২১ মার্চ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে মদ দুর্নীতির অভিযোগে ইডি গ্রেফতার করার পর এই ইস্যুটি একটি নাটকীয় মাত্রা পায়।

কেজরিওয়ালের গ্রেফতার দিল্লি ও পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির নেতা-কর্মীদেরই শুধু সংহত করেনি, কংগ্রেসও তার গ্রেফতারির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নামে। রাহুল গান্ধী থেকে মমতা ব্যানার্জী বা তামিলনাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী স্টালিন – বিরোধী শিবিরের স্তম্ভরা সবাই তীব্র নিন্দায় সরব হন।

দিল্লিতে আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে তেমন সুসম্পর্ক না-থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজধানীর সাতটি লোকসভা আসনেই যে এই দুই দল মসৃণভাবে আসন সমঝোতা করতে পেরেছে– তার পেছনেও ক্যাটালিস্টের কাজ করেছিল কেজরিওয়ালের জেলে যাওয়া।

এই মুহুর্তে দিল্লির সাতটি আসনই বিজেপির দখলে– কংগ্রেস-আপ জোট বেঁধে লড়ায় যা ধরে রাখা বিজেপির পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে একটানা ৫০ দিন জেলে থাকার পর সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে গত সপ্তাহে কেজরিওয়ালকে নির্বাচনী প্রচার করার জন্য জামিন দিয়েছে– আর এই পদক্ষেপও বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

দিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষক কল্যাণ গোস্বামী বলছিলেন, কেজরিওয়ালকে ভোটের ঠিক আগে ইডি তুলে নেয়ায় আম আদমি পার্টির অনুকূলে একটা সহানুভূতির হাওয়া তৈরিই হয়ে ছিল।

‘এখন জেল থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়ে তিনি শুধু দিল্লিতেই নয়, উত্তরপ্রদেশ-পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো বিভিন্ন রাজ্যেই বিজেপির বিরুদ্ধে রীতিমতো ঝড় তুলছেন। আমি তো বলব বিজেপি সরকারের এজেন্সিগুলোই তাকে এই ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলার সুযোগ করে দিয়েছে।

পাশাপাশি, ভোটের ঠিক মুখে তার এই গ্রেফতার দৃশ্যতই ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবির ‘ইন্ডিয়া’কেও এককাট্টা করার সুযোগ করে দিয়েছে।

‘দিল্লির বুকে একজন নির্বাচিত ও ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা গেলে যে সব রাজ্যে বিরোধীরা ক্ষমতায়, সেই কর্নাটক, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু বা কেরালার মুখ্যমন্ত্রীদেরও যে কোনো দিন গ্রেফতার করা হতে পারে, এটা ‘ইন্ডিয়া’ বুঝে গেছে এবং সব বিরোধ ভুলে একজোট হয়েছে’, বলছিলেন গোস্বামী।

ফলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক পরে পরেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হাজতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা সমীচিন ছিল, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে পিছনে তাকিয়ে সে কথা এখন ভাবতেই হচ্ছে।

দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব-সহ বিভিন্ন রাজ্যেই দলটিকে এর চড়া মাশুল গুনতে হতে পারে!

পশ্চিমবঙ্গে ‘খেলা’ ঘুরে গেছে?
এবারের লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের আসনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিজেপি বিশেষ করে যে রাজ্যগুলোকে নিশানা করেছিল, তার মধ্যে একেবারে প্রথমেই ছিল পশ্চিমবঙ্গ।

আসন সংখ্যার বিচারে ৪২টি কেন্দ্র নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য– উত্তরপ্রদেশ (৮০) ও মহারাষ্ট্রের (৪৮) ঠিক পরেই।

গতবার পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ১৮টিতে। এবারে কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পর্যন্ত ওই রাজ্যে এসে প্রকাশ্যেই দলকে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫টি আসন জেতার টার্গেট বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন।

কিন্তু কলকাতায় বিবিসি বাংলার অমিতাভ ভট্টশালী বলছেন, নির্বাচন শুরুর ঠিক আগেও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন ছিল– এখন প্রায় রাতারাতি কিন্তু সেই অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গেছে।

আর এর পেছনে কাজ করেছে তিনটি ফ্যাক্টর– সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতন নিয়ে একের পর এক স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফাঁস, স্কুলে হাজার হাজার বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আদালতের রায় এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রুল জারি।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘খেলা হবে’ খুব পরিচিত ও চালু একটি শব্দবন্ধ। অমিতাভ ভট্টশালী বলছিলেন, সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে আপাতত পুরো খেলাটাই বোধহয় ঘুরে গেছে!

গোটা বিষয়টা ব্যাখ্যা করে অমিতাভ ভট্টশালী আরো জানাচ্ছেন- সন্দেশখালিতে নারীদের ওপরে ধর্ষণ আর নির্যাতনের অভিযোগ মাস কয়েক আগে যখন সামনে আসে, তখন থেকেই বিজেপি বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সরব হয়েছিল। সেখানকার ‘নির্যাতিতা’ নারীদের সাথে ভোট ঘোষণার আগেই দেখা করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

পুরো রাজ্যে তো বটেই, জাতীয় স্তরেও সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে প্রচারে নেমে পড়েছিল বিজেপি। সন্দেশখালি যে লোকসভা আসনের অন্তর্গত, সেই বসিরহাট থেকে প্রার্থীও করে দেয়া হয় নির্যাতিতা বলে পুলিশে কাছে অভিযোগ দায়ের করা নারীদের অন্যতম, রেখা পাত্রকে।

সন্দেশখালির নারীদের সারা রাজ্যেই প্রচারে নিয়ে যাচ্ছিল বিজেপি – যাতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের ঘটনাটা আরো জোরালোভাবে তুলে ধরা যায়।

এরপর হঠাৎই ময়দানে চলে এলো প্রথম ‘গেম চেঞ্জার’ বা খেলা ঘুরিয়ে দেয়ার ঘটনা।

সন্দেশখালির এক বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের সাথে গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড করা কথোপকথনে ফাঁস হয়ে গেল যে সেখানে কোনো ধর্ষণ বা কোনো নারী নির্যাতন হয়নি। তিনি ক্যামেরার সামনে স্বীকার করলেন, পুরোটাই ‘সাজানো’ ঘটনা, অর্থের বিনিময়ে ওই অভিযোগ করানো হয়েছিল বিজেপির নেতাদের পরিকল্পনায়।

রাজ্য রাজনীতিতে এরপর তোলপাড় পড়ে যেতে বিজেপি দাবি করলো যে উচ্চমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই ‘স্টিং অপারেশন’ চালানো হয়েছে। তবে ততক্ষণে ‘ড্যামেজ’ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বা অন্যান্য বিজেপি নেতা-নেত্রীরা সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতন নিয়ে অতি সরব ছিলেন, তারা এখন আর সেই প্রসঙ্গ সামনে আনছেন না।

যদি সন্দেশখালি প্রথম ‘গেম চেঞ্জার’ হয়, তাহলে দু নম্বরে থাকা প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনাও খেলা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো বড় ঘটনা।

শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি, সেই অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী, তার বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জী সহ গোটা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার তাবড় কর্মকর্তাদের জেলে যাওয়া, মন্ত্রীর বান্ধবীর দুটি ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ৫০ কোটি ভারতীয় টাকা উদ্ধার হওয়া বা কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে গান্ধী মূর্তির নীচে প্রায় চার বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বঞ্চিত চাকরীপ্রার্থীদের ধরনা – এসব খবরই বাসি হয়ে গিয়েছিল।

ভোটের প্রচারে খুবই কম উঠে আসছিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গটা।

কিন্তু ভোট চলাকালীনই কলকাতা হাইকোর্ট এক রায় দিয়ে জানিয়ে দেয় যে ২০১৬ সালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন স্কুলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে কে যে নিজের যোগত্যতায় চাকরি পেয়েছেন আর কারা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন, তাদের আলাদা করা সম্ভব নয়। তাই ওই বছর যে প্রায় ২৬ হাজার মানুষ স্কুলের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের সবার নিয়োগ বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।

আর এই রায়ের ফলে পথে বসেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের একটা বড় অংশ জড়ো হন কলকাতার শহীদ মিনারে। প্রতিবাদের সাথেই চলতে থাকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দাখিলের প্রস্তুতি।

শেষমেশ শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের রায়ের ওপরে স্থগিতাদেশ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বেনিয়ম যে হয়েছে, ঘুষ দিয়ে যে অনেকে চাকরি পেয়েছেন, সে কথাও বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। আর এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির দায় যে অনেকটাই তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরেই বর্তাবে, তা টের পাওয়া যায় মানুষের কথাতেই।

তৃতীয় ফ্যাক্টর হলো সিএএ। বিজেপি যেমন সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, তেমনই তারা আশা করেছিল যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার প্রায় চার বছর পরে ভোটের মুখে সেই আইনের বিধি জারি করে দিয়ে আইনটি চালু করলে তারা মতুয়া এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু ভোটের একটা বড় অংশ নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা বিজেপির অন্য নেতারাও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুফল তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন ভোট ঘোষণার আগে থেকেই।

তারা মনে করেছিলেন এই আইনটা হবে তাদের পক্ষে একটা ‘গেম চেঞ্জার’।

তবে আইন যখন চালু করা হল ভোট ঘোষণার ঠিক আগে, তারপর দেখা গেল একজনও সেই আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদনই করলেন না!

কারণ আইনের বিভিন্ন ধারায় যা যা বলা হয়েছে, তার অনেকগুলিই উদ্বাস্তু এবং মতুয়াদের বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে বিজেপিরই একাংশ স্বীকার করছে।

তাই যেটাকে এক সময় ‘গেম চেঞ্জার’ বলে তারা মনে করছিলেন, সেটা খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই খেলা বিজেপির বিপক্ষে চলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে”, কলকাতা থেকে জানাচ্ছেন অমিতাভ ভট্টশালী।

আর ঠিক এই সব কারণেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির আসন খুব একটা বাড়বে, এই সম্ভাবনাও এখন বেশ ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।

কর্নাটক, বিহার, মহারাষ্ট্রে ক্ষতি?
এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি শেষ পর্যন্ত গতবারের তুলনায় কীরকম ফল করে, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যের ওপর।

এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বিহার। ২০১৯র নির্বাচনে বিজেপি জোট কর্নাটকে ২৮টির মধ্যে ২৫টি, মহারাষ্ট্রে ৪৮টির মধ্যে ৪১টি ও বিহারে ৪০টির মধ্যে ৩৯টি আসন জিতেছিল।

ভারতে প্রবীণ সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই-এর মতে, মহারাষ্ট্র হলো- এবারে গোটা দেশের প্রধান ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ – অর্থাৎ ওই রাজ্যটিতেই বিজেপি জোটের সাথে বিরোধীদের সবচেয়ে কঠিন লড়াই হচ্ছে।

‘কিন্তু বিজেপি যেভাবে মহারাষ্ট্রে অন্য দলগুলোকে ভাঙিয়ে সরকার গড়েছে এবং রাজ্যে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের যা পারফরমেন্স তাতে রাজ্যের মানুষ এবারে তাদের ওপর কতটা ভরসা রাখবেন আমি নিশ্চিত নই,’ বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বিজেপি মহারাষ্ট্রে প্রথমে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা ও পরে শারদ পাওয়ারের এনসিপি – দুটো দলকেই ভেঙেছে যথাক্রমে একনাথ সিন্ধে ও অজিত পাওয়ারের মতো নেতাদের নিয়ে, তাদের নিয়ে রাজ্যে সরকারও গড়েছে।

কিন্তু শিবসেনা বা এনসিপি-র মূল দলগুলোর জনভিত্তি তারা নষ্ট করে ফেলতে পারেনি। এর প্রভাব লোকসভা আসনের ফলাফলে পড়তেই পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

রাজদীপ সারদেশাই আরও বলছিলেন, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটক দুটোই কিন্তু কৃষিপ্রধান রাজ্য। দুটো রাজ্যেই কৃষকরা সেচের জল বা ফসলের দাম নিয়ে বেশি চিন্তিত, মঙ্গলসূত্র বা হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির বিশেষ গুরুত্ব নেই তাদের কাছে।

এদিকে কর্নাটকে ভোটের মাঝপথে যেভাবে বিজেপির জোটসঙ্গী জনতা দল (সেকুলার)-এর নেতা প্রাজ্জ্বল রেভান্নার ‘সেক্স ভিডিও’ কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছিল এবং অভিযোগ উঠেছিল বিজেপি নেতৃত্ব সব জেনেশুনেও ওই দলের সাথে হাত মিলিয়েছেন – সেটাও দলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেনি।

তবে জনতা দল (সেকুলার)-এর যেটা শক্ত ঘাঁটি, সেই দক্ষিণ কর্নাটকে তার আগেই ভোট মিটে যায়, বিজেপির জন্য সেটাই যা বাঁচোয়া।

বিহারেও ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতীয় রাজনীতির ‘পালটু রাম’ (যিনি ঘন ঘন দল বা শিবির পাল্টান) নামে পরিচিত নীতিশ কুমারের সাথে আবার হাত মেলানোটা বিজেপির জন্য কতটা লাভজনক হবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে ইতোমধ্যেই।

রাজস্থানেও (যেখানে বিজেপি গতবার ২৫-এ ২৫ পেয়েছিল) রাজপুতদের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভের আঁচ এবার ভালই মিলেছে, যার প্রভাব পড়তে পারে আসন সংখ্যাতেও।

ফলে দেশে এরকম অন্তত তিন-চারটি বড় রাজ্য আছে, যেগুলোকে রাজনৈতিক পন্ডিতরা বিজেপির জন্য ‘লোকসানের খাতা’তেই ধরছেন।

সাত দফার নির্বাচন বড্ড লম্বা!
ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন টানা প্রায় দেড় মাস ধরে সাত দফার সুদীর্ঘ নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করে, ক্ষমতাসীন বিজেপি সেই পদক্ষেপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী মোদি বা অমিত শাহ-জে পি নাড্ডার মতো দলের তারকা প্রচারকরা এর ফলে সারা দেশে ঘুরে ঘুরে অজস্র জনসভা আর রোড শো করার সুযোগ আর সময় পাবেন, তখন এটাই ছিল দলের প্রাথমিক ক্যালকুলেশন।

বস্তুত এত দীর্ঘ সময় ধরে সংসদীয় নির্বাচন ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি – একমাত্র ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন ছাড়া। যদিও সেবারের নির্বাচনে কয়েক মাস সময় লাগার কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যত ভোট এগোচ্ছে, দেশে তাপপ্রবাহও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে – এবং ভোট পড়ার হারও গতবারের তুলনায় অনেক কম হচ্ছে।

এখন এই কম ভোট পড়ার হার ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাবে, না কি বিপক্ষে সেটা বলা খুব মুশকিল।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি বা বিজেপির পক্ষেও যে খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিতে মানুষ এগিয়ে আসছেন না – সেটা দলের নেতাদের কাছেও স্পষ্ট।

কিংবা হয়তো দলের সমর্থকরাও অনেকে ভাবছেন বিজেপি তো জিতেই বসে আছে, আমি ভোট দিতে না-গেলেও বা কী আসে-যায়!

বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষক শুভ্রকমল দত্ত অবশ্য দাবি করছেন, মারাত্মক গরমই কম ভোট পড়ার একমাত্র কারণ – আর বিজেপি যেহেতু ‘প্রো-ইনকামবেন্সি’তে ভর করে ভোটে লড়ছে তাই এতে তাদের চিন্তিত হওয়ারও কোনও কারণ নেই।

কিন্তু ‘প্রো-ইনকামবেন্সি’কেও এত দীর্ঘ সময় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। তাছাড়া এবারের নির্বাচনে স্পষ্ট কোনো ‘জাতীয় ন্যারেটিভ’ও সেভাবে চোখে পড়ছে না।

২০১৪-তে যেমন ছিল দেশে ‘বলিষ্ঠ নেতৃত্ব’ আনার ডাক, কিংবা ২০১৯-এ পুলওয়ামাতে জঙ্গী হামলার পর জাতীয় নিরাপত্তার দাবি– এবারে সেরকম কোনো নির্ণায়ক ফ্যাক্টর নির্বাচনে নেই।

দিল্লিতে বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা বিবিসির কাছে স্বীকারই করছেন, এখন মনে হচ্ছে ভোটটা ১০০ মিটারের স্প্রিন্ট বা নিদেনপক্ষে মিডল ডিসট্যান্স রান হলেই বোধহয় ভাল হত। এই ম্যারাথনটা টানা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

তবে এত হিসেবনিকেশের পরও বিজেপি জোট প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়া জোটের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে – এটা অবশ্য বিশ্লেষকরা কেউই বলছেন না।

তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী অবশ্য জনসভায় দাবি করেছেন বিজেপি ১৯০-১৯৫টির বেশি আসন কিছুতেই পাবে না, সেই জায়গায় ইন্ডিয়ার ঝুলিতে আসবে কম করে ৩১৫টি।

বিজেপির নেতারা আবার প্রকাশ্যে নিজেদের আসন ৩৫০-র নিচে কিছুতেই নামাতে চাইছেন না!

কিন্তু নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি যারা খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা অনেকেই ধারণা করছেন বিজেপির জন্য ২৭২র ম্যাজিক নাম্বারে পৌঁছানোটাও হয়তো শেষমেশ বেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সূত্র : বিবিসি