কঠোর পরিশ্রম ছাড়া প্রতিভা কোন কাজে আসে না । জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন; বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। কবির ভাষার সাথে কর্মের মিল আজ শতভাগ মিলে যায়। সত্যই নারীরা আজ বসে নেই, নেই চার দেওয়ালে বন্দী। সামাজিকভাবে নারীদের অধিকার অনেকাংশেই আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন নারীরা৷ কখনো আবার যোগ্যতার বলে পুরুষদের নেতৃত্বও দিচ্ছেন এই নারী সমাজ৷সারাদেশের মত পাবনার নারীরাও শুধু নিজের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটাচ্ছে না দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অগ্রনী ভূমিকা পালন করছেন। নিজ পায়ে দাঁড়ানো ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতিযোগীতায় শতশত নারীর মধ্যে পাবনার অনুজা সাহা এ্যানি একটি সুপরিচিত দৃষ্টান্ত। নারী উদ্যোক্তা মহলে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে জায়গাই করেই শুধু নেননি। নিজের স্বাবলম্বী হয়েছেন, করেছেন বহু নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। পেটের জ্বালা নিবারণে পথ তৈরি দিয়েছেন স্বনাম ধন্য এই সুশিক্ষিত খাদ্য উদ্যোক্তা। নারীদের সচেতনভাবে দৈনন্দিন জীবনের ব্যক্তিগত বিকাশকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে, লক্ষ্য অর্জন, পরিপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের প্রেরণাময়ী অনুজা সাহা এ্যানি কোন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন না। অনুজা সাহা উদ্যোক্তা জীবণে পা দিয়ে আজ স্বয়ংসিদ্ধা। কারো উপরে নির্ভরশীল নন। উল্টো তার উপড়ই দাঁড়িয়ে আছে নিজ পরিবার-পরিজন এবং দৈন্দিন কর্মজীবি কিছু নারী-পুরুষ।
সফল হতে তেমন কিছু লাগে না। লাগে কেবল মেধা, গুণ, নিষ্ঠা আর শ্রম। এগুলো আঁকড়ে ধরে থাকলেই সাফল্য একদিন আসবেই। এমন চিন্তা-চেতণা আর মনোবল নিয়ে এক যুগের অধিকাল ধরে এগিয়ে চলা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অদম্য এই নারী অনুজা সাহা এ্যানি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।বলা যায় বিন্দু থেকে আজ সিন্ধুতে তিনি
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারনে কখনো কখনো ব্যর্থতা-হতাশা এমন ভাবে তাকে ঘিরে ধরেছিলো, তার কাছে মনে হয়েছে আর এগোনো হয়তোবা সম্ভব হবে না, তবুও তিনি হাল ছাড়েননি, দমে যাননি নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। তিনি আজ স্বচ্ছল সাবলম্বী নারী। তিনি নিজেই স্বনির্ভর হননি-প্রায় ৪০/৫০ জন নারীর কর্মস্থানের সুযোগ তিনি তৈরি করে দিয়েছেন।

পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার অমূল্য কুমার সাহা ও অঞ্জনা সাহার একমাত্র সন্তান অনুজা সাহা। শহরের এতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেলিম নাজির উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক (অবঃ) শহরের বহু মানুষের শ্রদ্ধারপাত্র অমূল্য সাহা ও তাঁর সুদক্ষ গৃহিনী অঞ্জনা সাহার অনেক স্বপ্ন ছিলো তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান অনুজা সাহা এ্যানিকে ঘিরে।
স্কুলের গন্ডি পেড়িয়ে সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি পাশ করান মেয়েকে। মানুষ গড়ার কারিগর অমূল্য সাহা’র বহু প্রিয় ছাত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে চাকুরী করলেও অনেক চেষ্টা তদবির করে নিজের মেয়ের জন্য একটি সরকারী বা বেসরকারী চাকুরীর জোগাড় করতে পারেননি তিনি। মনোকষ্ঠ নিয়ে ৮২ বছর বয়সী বৃদ্ধ শিক্ষক অমূল্য সাহা প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার জীবনে যুদ্ধ করে চলেছেন। আলাপ চারিতায় অনুজা সাহা বলেন, ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারী আমার জন্ম।
বাবার মুখে শুনেছি ৩ বছর বয়স থেকে নৃত্য এবং পরে সঙ্গীত চর্চা তার শুরু হয় আমার। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর থেকে নানা অনুষ্ঠান আর প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহন করে নানা পুরস্কার ও সনদ অর্জন করেন তিনি। এইচএসসি পাশ করার পর আকস্মিক ভাবে তার বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবণে তাদের কোল জুড়ে একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। নাম রাখা হয় অর্ণব। ছেলের বয়স এখন ৮ বছর। স্বামীর ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে সংসার জীবণে দিশেহারা হয়ে পড়েন অনুজা সাহা। এমএসসি পাশ করে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন চাকুরীর জন্য অনুজা সাহা। ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকুরী।
কোথায়ও কোন কর্মের সংস্থান হয় না। পত্র-পত্রিকায় দেশের বিভিন্নস্থানের নারী উদ্যোক্তার গল্প পড়ে উদ্ধুদ্ধ হন অনুজা সাহা এ্যানি। চাকুরীর আশা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা নেন তিনি। অনুজা সাহা’র মা অঞ্জনা সাহা মেয়ের ব্যবসা করার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন। সংসার জীবনের নির্মম বাস্তবতার কষাঘাতে মেয়ে যখন জর্জরিত মা তখন সম্মতি দেন ব্যবসা করার। অনুজা সাহার মা ছিলেন সুদক্ষ একজন রাধুঁনী। সিদ্ধান্ত নেন খাবারের ব্যবসা করার। মায়ের সহযোগীতায় স্বল্প পুঁজি নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে খাবারের হোম ডেলিভারী সার্ভিস চালু করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের না দেওয়া হয় অর্ণব এন্ড কোং। হোম ডেলিভারী সার্ভিস থেকে নানা ধরনের পিঠা, কেক, মিষ্টি, বেকারী আইটেম, সাদা ভাত, বিরানী সরবরাহ শুরু হয় পাবনার নানা স্থানে।
বিভিন্ন স্থানের বড় বড় অর্ডার পেতে শুরু করে অর্ণব এন্ড কোং। ধীরে ধীরে এ ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। পুঁজির পরিমাণও বেড়ে যায়। এখানেই অনুজা থেমে নেই। বিসিক, যুব উন্নয়ন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষন নেন। মায়ের কাছ থেকে সেলাই ও কাটিং এর কাজ শেখেন তিনি। সেটা কাজে লাগাতে শুরু করেন। পাশাপাশি শুরু করেন বুটিক হাউস ব্যবসা। সেটাও আলোর মুখ দেখতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চায় পারদর্শী অনুজা গড়ে তোলেন ‘মন ময়ূরী’ নামের আরেকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এখানে আর্ট, নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি, সুন্দর হাতের লেখা শেখানো শুরু হয় কোমলমতি শিশুদের। অনুজা জানায়, তার খাবারের প্রতিষ্ঠানে ৩০/৩৫ জন ও বুটিক হাউজে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছে। অনুজা সাহা বলেন, আজ তিনিই শুধু সাবলম্বী হননি, অনেক দরিদ্র মানুষেরকর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।এরমধ্যেই তিনি ডিসি অফিস সংলগ্ন জেলাপাড়ায় অগ্রনী ভ্যাংক কোর্ট রোড শাখান নীচে ‘মায়ের পরশ নামের
একটি রেষ্টুরেন্ট করেছেন। বাঙালী ঘাবার থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান কিছু খাবার নিয়েও সেখানে কাজ করছেন। দরিদ্র মানুষের স্বল্প বাজেটের খাবারসহ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের খাবারও তার রেষ্টুরেন্টেস্থান পেয়েছে। অনুজা সাহা জানান, তার তৈরিকৃত খাবারের মধ্যে রয়েছে, সকালের ১০ টাকার নাস্তায় রুটি, পরেটা সবজি, ডাল, দুপুর ও রাতের হরেক রকম প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে ১শ’ টাকায় সাদাভাত, বয়লার মুরগীর গোস৩ পিচ, ছোটমাছ, ডাল, সুক্তো, শাকভাজি, তিন রকমের ভর্তা, চাটনী, ৫ রকমের ভর্তা, মাছ, ভাজি বা ভুনা, চাটনী, ডাল, মুড়ি ঘন্টো, কুমড়ো ছক্কা, ইলিশ মাছ, আনলিমিটেড খিচুড়ি, ৫ রকমের ভর্তা, হাঁসের মাংস, চিংড়িমাছ, খাসির গোস, মুগীর ঝাল ফ্রাই, আনলিমিটেড বাসমতি চালের পোলাও, ৫ রকমের ভর্তা, দুই পিস খাসির মাংস। এছাড়াও বিকেল-সন্ধ্যায় লুচি, আলুরদম, পাপড়ী চাট, তির রকমের ফুচকা, কচুরী, ঘুগনী, চিকেন কবিরাজি-লুচি, চিকেন চাপ, পাউ ভাজি, হাঁসের গোস, কালাই রুটি, ভর্তা, ভেলপুরি, চিজ চিকেন পাপড়ি চাট, কচুরি ও খাসির মাথা দিয়ে ঘুগনি, স্পেশাল চিকেন বার্গার, মমোসহ নানা স্বাদের মুখোরোচক খাবার। খাবারের আইটেম প্যাকেজ ভেদে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দাম। কথা হয় অনুজা সাহার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত আলপনা, পূর্নিমা, অমলা, কৃষ্ণা, পারভিন, রেখা, লায়লা, রেহেনা, জলি, রাকিব, ফয়সাল, রনি, সুলতানা, নাসিমা, ইসমা, তৃপ্তি, স্মৃতি ও রূপাসহ অনেকের সাথে। তারা বলেন, অভাব অনটনে অনেক কষ্টে, সৃষ্টে আমরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার জীবণ কাটাতাম।সংসারের কাজের পাশাপাশি আমরা এই প্রতিষ্ঠানের কাজ করে অনেকটাই স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছি আজ। দরিদ্রতা অনেক কমে গেছে। স্বামী-সন্তানের মুখাপেক্ষি তেমন হতে হয় না। বরং কর্ম করে পরিবারকে সযোগীতা করছি আর্থিক ভাবে। এর রকম অভাবের সংসারে স্বামীর স্বল্প আয়ে কষ্ট হতো। সংসারে লেগেই থাকত অভাব-অনটন অনেকেরই। সংসারের অভাব দূর করতে ঘরের বউ-ঝিরা নেমে পড়েনে কর্মে অনুজা সাহা সহ অনেক উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে।
অনুজা সাহা বলেন, পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থার কারনে অনেক নারীই এখনো পিছিয়ে আছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আমি আমার সাধ্যমত দরিদ্র নারীদের সহায়তাসহ সমাজের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। তবে সরকারী ভাবে আর্থিক সহযোগীতা পেলে আমার বিশ্বাস আরো এগিয়ে যেতে পারবো আমিসহ সকল উদ্যোক্তা। একই সাথে অন্যসব নারীদের অভাব অনটন ঘুচিয়ে আত্নস্বনির্ভর ও অর্থনৈতিক মন্দা দূর করে উন্নয়ন সহযোগী ভূমিকায় দাঁড়াবে নারী সমাজ। নারী তুমি এগিয়ে চলো, কাজই হোক আমার স্বপ্ন, কাজই আমার প্রেরণা, কাজই আমার চলার পথের সাথী, এই এগিয়ে চলার পথে যত জনকে সঙ্গে নিতে পারবো ততোই আমার আনন্দ বলে কথাগুলো এক বাক্যে হাসি মুখে উচ্চারণ করেন পাবনা শহরের উদ্যোক্তা আইকন অনুজা সাহা এ্যানি।