বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার পরে যে ‘কসাই’ তার রাশ টুকরো করেছিল বলে অভিযোগ, তাকে ভারতের কলকাতায় গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। শুক্রবার বারাসাত আদালতে তোলা হবে তাকে।

সতকর্তা: এই সংবাদ অনেকের উপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।

সিআইডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জানান, জিহাদ হাওলাদার নামে ওই ব্যক্তি বাংলাদেশী নাগরিক এবং তিনি অবৈধভাবে ভারতের মুম্বাইতে বাস করতেন। তার আদি বাসস্থান বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া থানার অন্তর্গত বারাকপুরে।

এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান দু’মাস আগে জিহাদকে কলকাতায় নিয়ে যান।

বৃহস্পতিবার জিহাদকে আটক করে একটানা জেরা করা হয়। তারা নিহত এমপি আনারের লাশ কলকাতা-সংলগ্ন কোনো এলাকায় ফেলে দিয়ে থাকতে পারে, সেটা জানার চেষ্টা করা হয়।

নিহত এমপির লাশের অংশের খোঁজে সিআইডি বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা পুলিশ এলাকার অন্তর্গত পোলেরহাট থানার কৃষ্ণবাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে তল্লাশি চালায়। নিউটাউন এলাকার যে ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করা হয়, সেই আবাসিক কমপ্লেক্সের সামনে দিয়েই এই খালটি বয়ে গেছে।

তবে সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি বলেই সিআইডি জানায়

লাশ লোপাটের বীভৎস বর্ণনা
সিআইডির ওই শীর্ষ কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পরে কিভাবে লাশ লোপাট করা হয়েছিল, তার ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়েছেন।

গ্রেফতার হওয়া জিহাদ সিআইডির জেরায় স্বীকার করেন, আখতারুজ্জামানের নির্দেশে ওই ফ্ল্যাটে সে এবং আরো চারজন বাংলাদেশী নাগরিক এমপি আনারকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘হত্যা করার পরে লাশ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে শরীরে মাংস আলাদা করে নেয় তারা। শরীরের মাংস এমনভাবে টুকরো করা হয় যেন তাকে চেনা না যায়। মাংস-খণ্ডগুলি পলি প্যাকেটে ভরা হয়। হাড়ও ছোট টুকরো করা হয়। এরপরে ফ্ল্যাট থেকে প্যাকেটগুলো বের করে বিভিন্নভাবে কলকাতার নানা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।’

ধৃত জিহাদ হাওলাদারকে শুক্রবার বারাসাত আদালতে তোলা হবে।

পুরো পরিকল্পনার বর্ণনা ঢাকার ডিবি প্রধানের মুখে
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডে তার কার্যালয়ে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

তিনি সংবাদ সম্মেলনে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা কোথায়, কখন, কিভাবে ও কারা সঙ্ঘটিত করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

তিনি জানান, এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান বা শাহীন। শাহীন এমপি আনারের বাল্যবন্ধু। তার সাথে ব্যবসায়িক বিরোধ কী নিয়ে ছিল, সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘২৫ এপ্রিল জিহাদ অথবা জাহিদ এবং সিয়াম কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনে বাসা ভাড়া করে। এ জন্য ৩০ এপ্রিল ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কলকাতায় যায়। হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত করবেন উনি ও আরেকজন। সাথে ছিলেন তাদেরই গার্লফ্রেন্ড। তিনজনে মিলে ৩০ এপ্রিল বিমানযোগে কলকাতা চলে যায়। যে বাসা ভাড়া করা হয় সেখানে তারা উঠে। বোঝাতে চায় এখানে পরিবার থাকবে। অপরাধের কোনো কিছু ঘটবে না।’

যুক্তরাষ্ট্রের নথি দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া
ভারতে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হলে মালিক এবং ভাড়াটিয়া, আর যে দালালের মাধ্যমে ভাড়া নেয়া হচ্ছে, সব পক্ষের ছবিসহ নথি স্থানীয় থানায় জমা দিতে হয়। আখতারুজ্জামান, আমানুল্লা সৈয়দ এবং সিলিস্তি রহমান ওই ফ্ল্যাটে থাকবেন বলে সেটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। মে মাসের এক তারিখে নিউটাউন থানায় এই নথি জমা করা হয়।

তার আগেই পুরো দল কলকাতায় পৌঁচায় বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

তিনজন থাকবেন বলে থানায় জমা দেয়া নথিতে লেখা থাকলেও ফ্ল্যাটটি সল্ট লেক অঞ্চলের এক দালালের মাধ্যমে ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামানই।

ভাড়া নেয়ার সময়ে নথি হিসেবে তিনি নিউইয়র্কের ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বরও জমা দিয়েছিলেন। রয়েছে তার ছবিও। পেশা হিসেবে তিনি সেখানে লেখেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানান, ‘ওই ফ্ল্যাটটি সন্দীপ রায় নামের পশ্চিমবঙ্গের শুল্ক বিভাগের এক অফিসারের।’

দু’মাস ধরে নজর রাখা হয়
ঘটনার পূর্ব পরিকল্পনা কিভাবে হয়েছে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘তারা দু’মাস যাবত এটাও খেয়াল করছিল ভিকটিম কবে আসা যাওয়া করে। কলকাতা কখন যায়। কারণ তিনি মাঝেমধ্যে কলকাতা যান। এবার ১২ মে সেখানে যান ও বন্ধু গোপালের বাসায় উঠেন। এখান থেকে তারাও সেখানে যায়। আরো দু’জনকে সেখানে ভাড়া করে।’

তিনি বলেন, ‘কলকাতার এই বাসাতে আসা যাওয়া করবে, এমন দুজনকে ঠিক করে। মাস্টারমাইন্ড সেখানে সব কিছু ঠিক করে, কোন গাড়ি ইউজ হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা থাকবে সেগুলো সব কিছু ঠিক করে অপরাধ সঙ্ঘটিত করতে পাঁচ-ছয়জনকে রেখে ১০ মে দেশে চলে আসে।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এমপি আনার কলকাতায় ১২ মে গিয়ে বন্ধু গোপালের বাসায় ছিলেন। পরদিন হত্যাকাণ্ড যারা ঘটায় তাদের সাথে যোগাযোগ হয় তার।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘১৩ মে উনার ওই চক্রটার সাথে কথা হয়। প্রথমে ফয়সাল নামের একটা ব্যক্তি সাদা গাড়িতে রিসিভ করে। সেখান থেকে নিয়ে কিছু দূরে যে মূল হত্যাকাণ্ডটা সঙ্ঘটিত করে সে, ফয়সাল ও ইন্ডিয়ান ড্রাইভার ছিল রাজা। সে (রাজা) আসলে কিছুই জানে না, সে ছিল ক্যারিয়ার। সে তাদেরকে নিয়ে ওই বাসায় যায়। ওই বাসায় যাওয়ার পরই মোস্তাফিজ নামে আরেকজন ঢুকে। জিহাদ ও সিয়াম আগেই ওই বাসায় ছিল।’

বিভ্রান্ত করতে এমপির ফোন থেকে মেসেজ
কলকাতায় এসে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার, সেই গোপাল বিশ্বাস আগেই জানিয়েছিলেন যে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এমপির ফোন থেকে একাধিক মেসেজ পেয়েছিলেন তিনি।

সেই মেসেজে কখনো বলা হয়েছিল যে তিনি (এমপি) সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন, কখনো জানানো হয় যে তিনি বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছেন। আবার দিল্লিতে যে তিনি পৌঁছেছেন আর তার সাথে ‘ভিআইপি’রা আছেন, সে কথাও জানান বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে।

ঢাকার ডিবি প্রধান জানান, ‘টোটাল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে লাশ গুম করা, অস্তিত্ব যেন কখনো না পাওয়া যায়। অন্যদিকে তদন্তকারীরা যেন কোনো ডিভাইস খুঁজে না পায়। আবার ইন্ডিয়ান পুলিশের নজর যেন বাংলাদেশে না আসে।’
সূত্র : বিবিসি