নৌরুটগুলো যেন মরণফাঁদ
দৈনিক বার্তা-ঢাকা,৬আগষ্ট : ধান,নদী খাল তিনে মিলে বরিশাল এই প্রবাদটি কালের বির্বতনে এখন রুপকথায় পরিণত হতে চলেছে৷ এক সময়ের খরস্রোতা নদীগুলো এখন অনেকটাই বিলীন প্রায়৷ পানিশূন্য হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের তিন হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ এখন মরণফাঁদে রূপ  নিয়েছে৷পদ্মা, মেঘনা,যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সাগর মোহনার এই নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ দুই দিক থেকে বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের কারণে ভয়াবহ স্রোত উত্তাল হয়ে ওঠে৷ ফলে বর্ষা মৌসুমে ঘটে অহরহ নৌ দুর্ঘটনা৷ যার কবলে পড়ে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত মানুষ৷  সোমবার নিরাপদে বাড়ি গিয়ে ঈদ করার পর খুশিমনেই ঢাকায় ফিরছিলেন তাঁরা৷ যাত্রাপথও সামান্য৷ মাত্র ১৬ কিলোমিটার৷ মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাট৷ উত্তাল পদ্মা৷দেড় তলা ছোট লঞ্চ৷ কিন্তু যাত্রী কানায় কানায় পূর্ণ৷ মাওয়া  ঘাটের কাছাকাছি এসেও গিয়েছিল লঞ্চটি৷ কিন্ত তীরে ভেড়া হলো না৷ঢেউ আর স্রোতের টান, সঙ্গে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ; ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে ডুবে গেল লঞ্চটি৷ প্রশাসনের তদারকি আর অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করল নিরীহ যাত্রীরা৷

বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দাবি, এমএল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটিতে তিন শতাধিক যাত্রী ছিল৷ কিন্তু এর ধারণমতা ছিল ৮৫ যাত্রীর৷ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপরে (বিআইডবি্লউটিএ) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সব দেখে যাত্রীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার  অনুমতি দেওওয়ার নিয়ম৷ কিন্তু সে নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে ঘাটে ঘাটে৷ সরকারি হিসাবে বুধবার পর্যন্ত মাত্র ১১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ লঞ্চটি এখন পযনর্্ত ইদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ এ পর্যন্ত আরও অন্তত ১২৫ জনের পরিবার তাঁদের স্বজন নিখোঁজ হয়েছেন দাবি করে মুন্সিগঞ্জ  জেলা প্রশাসনের কাছে নাম তালিকাভুক্ত করেছেন৷  মাওয়া ঘাট সিবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীনু খান কে বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়া ঘাটে থাকা ২৫টির মতো স্পিডবোট দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যায়৷ বোটগুলো ৮০ থেকে ৯০ জনকে উদ্ধার করে৷ডুবে যাওয়া লঞ্চটির খোঁজে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোরালো েেকানো উদ্ধার  তত্‍পরতাই শুরু হয়নি৷ ফায়ার সার্ভিস ঘটনার পরপর উদ্ধার তত্‍পরতায় নামলেও কোনো ফল দেখা যায়নি৷

২০০৫ সালে যমুনা নদীতে দুর্ঘটনার শিকার হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল রায়পুরা৷ এতে শতাধিক যাত্রী নিহত হন৷ নিখোঁজ থাকেন আরও শতাধিক যাত্রী৷ ওই ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি হয়৷ তারা সরকারকে একটি প্রতিবেদনও দেয়৷ দুর্ঘটনা রোধে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়  প্রতিবেদনে৷ তারপর আর কিছু হয়নি৷  স্বাধীনতার পর থেকেই লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে বারবার এই একই চিত্র দেখা গেছে৷ যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়, তখন সরকারের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হলেও তা একসময় থেমে যায়৷ কেউই শাস্তি পায় না৷ এরপর আবার দুর্ঘটনা বাড়ে, মৃতু্যর মিছিলও বাড়ে৷ দেশে প্রতিবছরই লঞ্চ  দুর্ঘটনা ঘটলেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তথ্য পাওয়া যায় গত দুইদশকের ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত৷ এই ২০ বছরে ৬৫৮টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক৷ আর দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ আছেন আরও প্রায় দেড় হাজার জন৷ তাঁদের লাশ আর  কখনো পাওয়া যাবে না৷ এসব লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৩৯৩টি পরিবার৷ আর একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে আরও ৬৫৬টি পরিবার৷

বেসরকারি সংগঠন নৌ,সড়ক ও রেল খাত রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর) এই হিসাব দিয়েছে৷ আর সরকারের সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডস) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবি্লউটিএ) তথ্য অনুযায়ী এই সময়ে ৩৮৯টি দুর্ঘটনায় নিহত প্রায়  দুই হাজার ৯০০ জন৷ নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৬০০ জন৷  সরকারের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার পর উচ্চপর্যায়ের পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়৷ কিন্তু সব ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়নি৷ কিছু জমা পড়লেও তা প্রকাশ করা হয়নি৷ এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে৷ এসব  কমিটির মতে, লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী নৌযানের ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যুবোঝাই এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস না মানা৷ আবার বেশির ভাগ নৌযানে প্রাণরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও থাকে না৷ বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে  করা এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই৷ দেখা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তা আর কার্যকর হয়নি৷

সোমবার পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চেও ধারণক্ষমতার প্রায় চার গুণ অতিরিক্ত যাত্রী ছিলেন৷ লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ৮৫ হলেও তাতে যাত্রী তোলা হয় প্রায় ৩০০৷বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মীর তারিক আলী  বলেন, স্বাধীনতার পর লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে পাঁচ শতাধিক তদন্ত হয়েছে৷ কিন্তু এসব তদন্ত কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়নি৷ ফলে প্রতিবেদনগুলো মূল সমস্যার জায়গায় যেতে পারছে না৷ তিনি বলেন, লঞ্চমালিকেরা রোটেশন পদ্ধতি চালুর নামে লঞ্চে যাত্রীদের অতিরিক্ত যাত্রী হতে বাধ্য  করছেন৷ এর অবসান হওয়া উচিত৷ দ্বিতীয়ত, লঞ্চের নকশায় পরিবর্তন আনা দরকার৷ দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের নকশায় লঞ্চ তৈরি হচ্ছে৷ কিন্তু পারিপাশ্বর্িক অবস্থা যেমন্তআবহাওয়া, নদীর গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে৷

তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ৬৪টি ছোট-বড় লঞ্চ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি, এক হাজার ২০৫ জন মারা যান; আর নিখোঁজ ছিলেন ৫৬ জন৷ পরের বছরেই মারা যান আরও ৪৮৭ জন৷ আবার ২০০৮ সালে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০১ জন এবং ২০০৯ সালে ৩০৯ জন৷  সর্বশেষ বড় লঞ্চ দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালে৷ মেঘনায় নিমজ্জিত হয় এমভি শরীয়তপুর-১৷ এতে ১৪৭ জন যাত্রী প্রাণ হারান৷ সে সময়ও যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়৷ ভবিষ্যতে লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ তদন্ত কমিটিও একাধিক সুপারিশ  করে৷ কিন্তু সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন আর হয়নি৷ তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশে লঞ্চের নকশা অনুমোদন নেওয়া, প্রতিটি বন্দরে পরিদর্শক রাখা, চালকদের দক্ষতা পরীক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়৷ তা ছাড়া লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই বন্ধে লঞ্চ ছাড়ার প্রতিটি স্থানে পরিদর্শক  রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়৷ কিন্তু কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি৷  দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চমালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে৷ বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না৷ মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী  ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, এমন নজির নেই৷ তা ছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না৷ তাঁকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়৷ ফলে দায়ী কেউই শেষ পর্যন্ত  শাস্তি পান না৷

অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ও ফারাক্কা বাঁধের পর পানি প্রবাহের প্রধান উত্‍স পদ্মা ও মেঘনা নদীতে স্রোত কমে যাচ্ছে৷ এর ফলে শাখা নদীগুলোতে পলি জমে প্রতিবছর অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে নদীর নাব্যতা হারাচ্ছে৷ প্রায় দেড় হাজার  কিলোমিটার নৌ-পথ ইতোমধ্যে নাব্যতা হারিয়ে নৌ-যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে৷  নাব্যতা সংকটের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে এ অঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট৷ আরো তিনটি রুট বন্ধ হওয়ার উপক্রম৷ নৌ-রুটের এ নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে না পারায় বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে৷  দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে যাতায়াতের সহজ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ৷ বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা এবং ৪০টি উপজেলার কয়েক কোটি মানুষ ৮৮টি নৌ-পথে যাতায়াত করে৷ কিন্তু এর মধ্যে শীত ও শুস্ক মৌসুমে নাব্যতা হারিয়ে ২৮টি  রুট লঞ্চ চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে গেছে৷৩৮টি রুটে ডাবল ডেকার লঞ্চ চলাচল করতে পারলেও বাকি অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে চলাচল করে এমএল টাইপের লঞ্চ৷

বিআইডবি্লউটিএ’র তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন লক্ষাধিক লোক এসব রুটে যাতায়াত করে থাকে৷ প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথই থাকে চলাচলের অনুপযোগী৷  নাব্যতা সংকটের কারণে পাঁচটি নদীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নৌ-চলাচল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বন্দরগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এছাড়াও নাব্যতা সংকটে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের ধানসিঁড়ি নদীটিও এখন মরা খালে রূপ নিয়েছে৷

যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ফারাক্কা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে এ বছর বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেয়েছে তা গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যার চেয়ে অনেক কম৷ বিআইডবি্লউটিএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১৪’শ  কিলোমিটার নয়, সারাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷ নদীতে এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচলের জন্য কমপক্ষে ৮/৯ ফুট পানি প্রয়োজন, ডাবল ডেকার লঞ্চের জন্য প্রয়োজন ১৪/১৫ ফুট পানি৷

কীর্তনখোলা, লোহালিয়া, বিষখালী, পায়রা, নিশিন্দা, ইলিশা, কালাবদর, তেঁতুলিয়া, গণেষপুরা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ, ঝুনাহার, ধানসিঁড়ি, পয়সারহাট ও পালরদী নদীর পানি কমে নদীতে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর৷ বরিশাল থেকে ঢাকাগামী ভাষানচর ও চরনাইন্দা, পয়সারহাট থেকে  ঢাকাগামী মীরেরহাট, বিষারকান্দি-হারতাসহ মেহেন্দিগঞ্জের কয়েকটি চ্যানেলের অবস্থা খুবই নাজুক৷