জামায়াত নেতা মীর কাসেমের ফাঁসিদৈনিকবার্তা-ঢাকা,২নভেম্বর : জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃতু্যদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল৷রোববার আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল জনাকীর্ণ ট্রাইবু্যনালে এ রায় ঘোষণা করে৷ট্রাইবু্যনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম৷

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ট্রাইবু্যনালের এজলাসে আসেন তিন বিচারপতি৷এর আগে ট্রাইবু্যনালের কাঠগড়ায় আসামি মীর কাসেম আলীকে হাজির করা হয়৷ রায় ঘোষণার প্রাক্কালে সূচনা বক্তব্য দিয়ে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান৷ তিনি বলেন, গত ৪ মে এ মামলার যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শেষ হয়৷ মামলায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৩টি অভিযোগের ক্ষেত্রে আমরা একমত পোষণ করেছি৷ একটির ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধাদ্ধ হয়েছে৷ রায়টি মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার৷ মূল রায়ে ১০৪৬টি প্যারা রয়েছে৷ এর মধ্যে ১১ পৃষ্ঠা উপস্থাপন করা হবে৷রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশন আনীত ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলী দোষী প্রমাণিত হয়েছেন৷ তবে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস (অব্যাহতি) দেয়া হয়৷

প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদন্ড দেয়া৷ ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাকে ৭ বছর করে মোট ৪২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে৷ এছাড়াও ১৪ নম্বর অভিযোগ ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে৷ এই ৮টি অভিযোগে তাকে সর্বমোট ৭২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে৷ ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে মৃতু্যদন্ড দেয়া হয়েছে৷ ১১ নম্বর অভিযোগে রয়েছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ছয়জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ৷ এ অভিযোগে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে মীর কাসেমকে মৃতু্যদন্ডের আদেশ দেন৷ ১২ নম্বর অভিযোগে রয়েছে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ৷ এ অভিযোগে বিচারকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়৷ ১১ ও ১২ নং অভিযোগ ছাড়া বাকি ১২টি অভিযোগই অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ মীর কাসেমের বিরম্নদ্ধে৷

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিসত্মানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্রগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা রায়ে প্রমাণিত হয়েছে৷

গত ৩০ অক্টোবর মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার রায় রোববার ঘোষণার দিন ধার্য করে দেয় ট্রাইবু্যনাল-২৷ গত বুধবার জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে মৃতু্যদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়৷ এর মাত্র তিনদিন পর রোববার মীর কােেসম আলীর মামলায় রায় দেয়া হলো৷এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের একাদশ রায়৷

জামায়াত নেতা ও দিগনত্ম মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৪ মে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়৷প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জাতির দায়মুক্তির আরেকটি রায়৷ এ আসামির বিরম্নদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণে সৰম হয়েছে প্রসিকিউশন৷ সর্বোচ্চ শাসত্মি মৃতু্যদন্ড হওয়ায় তিনি সনত্মোষ প্রকাশ করেন৷ তিনি আরও বলেন, ৭১ সালে য সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে বিশ্বমানবতার হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলে৷

ট্রাইবু্যনালের প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য রানা দাস গুপ্ত রায়ে সনত্মোষ প্রকাশ করে বলেন, মীর কাশেম মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্রগ্রাাম কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ তিনি ওই সময় চট্রগ্রাম কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি, চট্রগ্রাম শহর শাখারও সভাপতি ছিলেন৷ পরবর্তীতে ৭১’ এর ৬ নভেম্বর পাকিসত্মান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং পূর্ব পাকিসত্মান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদেও অধিষ্ঠিত হন৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাশেম আলী ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করেন৷ সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাশেম আলী চট্রগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন৷

রানা দাস গুপ্ত বলেন, চট্রগ্রাম শহরের চামড়ার গুদাম, সালমা মঞ্জিল, ডালিম হোটেলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মীর কাশেম আলী তার সহযোগীদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলেন৷ এসব নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে মানুষকে ধরে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন এবং হত্যাকান্ড ঘঠান৷ যা সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে মামলায় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রসিকিউশন৷প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, এই বিচারের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ পেরোলো জাতি৷ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো৷

আসামি পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে সকল প্রমাণাদির ভিত্তিতে দন্ড দেয়া হয়েছে, তাতে এই রায় দেয়া যায় না৷ এ রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানান তিনি৷মীর কাসেমের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়৷ ট্রাইবু্যনাল ও আশপাশ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন৷ সুপ্রিমকোর্ট ও ট্রাইবু্যনালে প্রবেশের সবগুলো ফটকে পুলিশ ও র্যাব অবস্থান নেয়৷ ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়৷

মামলায় মীর কাসেমআলীর বিরুদ্ধে মামলার তদনত্মকারী কর্মকর্তা (আইও) নুরম্নল ইসলামসহ প্রসিকিউশনের ২৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন৷ আসামিপক্ষ তাদের জেরা করেছেন৷ এরপর মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার েছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ তিনজন৷ প্রসিকিউশন তাদের জেরা করে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইবু্যনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাশেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়৷ সে থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন৷

আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এই ট্রাইবু্যনালে এটি দ্বিতীয় রায়৷ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুস্টিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম প্রধান অঙ্গিকার ছিলো যুদ্ধপরাধীদের বিচার করা৷ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট দুই তৃতীয়াংশের বেশী আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে৷ সরকার গঠনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যুদ্ধপরাধীদের বিচারে সর্বসম্মত প্রসত্মাব গৃহীত হয়৷ এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইবু্যনাল, তদনত্মকারী সংস্থা ও প্রসিকিউশন গঠন করা হয়৷ প্রথমে ১টি ট্রাইবু্যনালে এ বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়৷ পরে এ বিচারকে ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরো একটি ট্রাইবু্যনাল গঠন করা হয়৷

বিচারিক কার্যক্রম শেষে পৃথক দুটি ট্রাইবুনালে এর আগে আরো ১০টি মামলায় রায় ঘোষিত হয়েছে৷ এসব মামলায় আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে ৯০ বছরের জেল, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী , আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজামান, আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচচু রাজাকার, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃতু্যদন্ড এবং বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমকে আমৃতু্য কারাদন্ড দেয়া হয়৷ ইতোমধ্যে গোলাম আযম, আব্দুল আলীম কারাগারে থাকাবস্থায় মৃতু্যবরণ করেন৷ বাচ্চু রাজাকার, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান পলাতক রয়েছেন৷

জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রায় দিয়েছিল ট্রাইবু্যনাল৷ এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষে আনা আপিল শুনানী শেষে দন্ড বাড়িয়ে কাদের মোলস্নাকে মৃতু্যদন্ড দেয় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ৷ পরে এ দন্ডাদেশ কার্যকরও করা হয়৷ সাঈদীকে দেয়া ট্রাইবু্যনালের রায়ের বিরম্নদ্ধে আসামি ও রাষ্ট্রপৰে আনা আপিল নিস্পত্তি করে তাকে মৃতু্যদন্ডের পরিবর্তে আমৃতু্য কারাদন্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ৷এছাড়া আরো ৫টি মামলা রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে৷ এর মধ্যে ৪টি ট্রাইবু্যনালে৷ অন্যটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে৷ রায় ঘোষণার অপেৰায় থাকা ট্রাইবু্যনালের ৪ মামলার আসামিরা হলেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, ব্রাম্মনবাড়ীয়ার মোবারক হোসেন, জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, বিএনপি নেতা ফরিদপুরের নগরকান্দার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন ওরুফে খোকন রাজাকার৷ এর মধ্যে খোকন রাজাকার পলাতক অন্যরা কারাগারে রয়েছেন৷

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইবু্যনালে দেয়া মৃতু্যদন্ডের রায় বিষয়ে আনা আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায় ঘোষণা অপেৰমান (সিএভি) রেখেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ৷যুদ্ধাপরাধে জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃতু্যদণ্ডের রায়ের তিন দিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটির টানা হরতালের হুমকির মধ্যেই এ রায় এলো৷

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাত্‍ মজলিসে শুরার এই সদস্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে ও দুটি আংশিক প্রমাণিত হয়েছে৷আংশিক প্রমাণিত দুটি অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ আটজনকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইবু্যনাল৷ এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে তিন বিচারক সর্বসম্মতভাবে প্রাণদণ্ডের রায় দিলেও ১২ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির সিদ্ধান্ত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে৷

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের দায়ের মীর কাসেমকে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷

ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ার সময় হালকা আকাশী শার্ট ও ঘিয়ে কোট পরিহিত মীর কাসেমকে শুরুতে কাঠগড়ায় বসে দৃশ্যত ফুরফুরে মেজাজে হাঁটুর ওপর আঙুল নাচাতে দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে৷
রায় শুনে মীর কাসেমের তির্যক মন্তব্য: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ও চট্টগ্রাম গণহত্যার হোতা এবং জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃতু্যদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২৷ রায় ঘোষণার পরপরই তিনি ট্রাইবু্যনালের উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য করেন৷

মীর কাসেম ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন,এটা মিথ্যা ঘটনা, মিথ্যা সাক্ষী, ফরমায়েশি সাক্ষী৷ সত্য বিজয়ী হবে৷ মিথ্যা পরাজিত হবে৷ শিগগিরই, শিগগিরই৷ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, “শয়তান.. শয়তান..৷মিথ্য ঘটনা… মিথ্যা সাক্ষ্য… কালো আইন…ফরমায়েশি রায়৷ সত্যের বিজয় হবে শিঘ্রই… শিঘ্রই৷

প্রসিকিউশন ৬২ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে৷জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি৷ ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে অংশ নেওয়া আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন তিনি৷

একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল৷ সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির৷ মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে৷

রায় ঘোষণার পর ট্রাইবু্যনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে৷ কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিলও হয়৷তাত্‍ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাসেমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, যে সকল প্রমাণাদির ভিত্তিতে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে এই রায় দেওয়া যায় না৷ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি৷ এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷এর বিরুদ্ধে আপিল করার কথাও বলেন তিনি৷

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, এই বিচারের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ পেরোলো জাতি৷ যেসব অভিযোগে আসামিকে আদালত খালাস দিয়েছে, সেগুলোতে আপিল করা হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে জানান আরেক প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ৷

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের একাদশ রায়৷রায়ের জন্য আসামি কাসেমকে শুক্রবারই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়৷ রোববার সকালে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইবু্যনালে আনা হয় একটি প্রিজন ভ্যানে করে ৷

জামায়াত নেতাদের আগের রায়গুলোর সময় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এবং নিজামীর রায়ের প্রতিবাদে হরতালের ঘোষণা থাকায় শনিবার েেথকেই ট্রাইবু্যনাল ঘিরে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা৷ সকালে ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়৷

আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইবু্যনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়৷ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানোর পাশাপাশি দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণারও দাবি তোলেন তারা৷

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করার পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেমকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ট্রাইবু্যনালের প্রসিকিউশন গতবছর ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে৷ গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মির কাসেমের যুদ্ধাপরাধের বিচার৷এরপর মামলাটি ট্রাইবু্যনাল-১ থেকে ট্রাইবু্যনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই ১৮ নভেম্বর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয়

শুনানি৷গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন৷

এরপর ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ তিনজন৷সাক্ষ্য-জেরা এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে চলতি বছর মে মাসে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়৷

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনেরররমধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়৷ ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে৷ পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি৷৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ৷