বিশ্ব ইজতেমা

দৈনিকবার্তা-গাজীপুর,১৬জানুয়ারি : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্‍ সম্মিলন বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে৷ টঙ্গীর তুরাগতীরে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুক্রবার বাদ ফজর শুরু হয়েছে৷ ময়দানে দেশ-বিদেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলি্ল অংশ নিয়েছেন৷ দ্বিতীয় পর্বে ইজতেমা চলবে তিন দিন৷ দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসলি্লর অংশগ্রহণে শুক্রবার ফজরের নামাজের পর থেকে ভারতের মাওলানা মো. ইসমাইল হোসেনের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব৷  শুক্রবার ভোর থেকে রাজধানী ঢাকা ও পাশর্্ববর্তী এলাকা থেকে বাস, ট্রাক, ট্রেন,নৌকাসহ বিভিন্ন যানবাহনে এবং পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে আসেন মুসলি্লরা৷ জিকিরের মধ্য দিয়ে আদায় করেন জুমার নামাজ৷ শিল্পনগরী টঙ্গী পরিণত হয় ধর্মীয় নগরীতে৷দুপুর ১২টার আগেই ময়দানের ১৬৫ একর এলাকাসহ পাশর্্ববর্তী এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়৷ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কামারপাড়া সড়কসহ আশপাশের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে মুসলি্লদের নামাজ আদায় করতে দেখা গেছে৷ বৃহত্তম জুমার নামাজের ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মো. জোবায়রুল ইসলাম৷

এদিকে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলি্লরা ছাড়াও ইজতেমা ময়দানে পৌঁছেছেন কয়েক হাজার বিদেশি মুসলি্ল৷ ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলীগ মারকাজের সূরা সদস্য ও বুজর্গরা বয়ান পেশ করেন৷ মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাত্‍ক্ষণিক অনুবাদ করা হয়৷ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠের চারদিকে পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে৷ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য মাঠের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিভিন্ন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে৷  গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হারুন উর রশিদ জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ যাতে মুসলি্লরা নিরাপদে ইজতেমায় যাতায়াত করতে পারেন৷গাজীপুরের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট মো. শরিফুল ইসলাম জানান, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণসহ ইজতেমাস্থল ও আশেপাশের অঞ্চলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে ওইসব অঞ্চলে মোবাইল কোর্ট বসানো হয়েছে৷ এসব অঞ্চলে প্রতিদিন দুই পর্বে পাঁচটি করে ১০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন৷গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বে ২০ জন ম্যাজিট্রেট নিয়েজিত ছিলেন৷ এবারও একই সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন৷ স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য ব্যবস্থা প্রথম পবের্র মতোই বহাল রয়েছে৷

মুসলি্লদের আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে ইজতেমা প্রাঙ্গণ৷বৃহস্পতিবার দুজন মুসলি্লর মৃতু্য হয়েছে৷ ইজতেমা ময়দানে ভারতের মাওলানা মো.ইসমাইল হোসেনের বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. নুরুর রহমান৷ বাংলার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় উর্দুর মূল বয়ান তরজমা করা হচ্ছে৷ বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই ময়দানে আসা মুসলি্লদের উদ্দেশে ঈমান, আমল ও আখলাকের প্রাক-বয়ান শুরু হয়৷ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরবি্ব গিয়াস উদ্দিন জানান, ইজতেমার মুসলি্লদের জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে৷

ইজতেমার লাশের জিম্মাদার আদম জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পটুয়াখালীর মো. বিল্লাল হোসেন (৩০) মারা গেছেন৷ ওই দিন বিকেলে বগুড়ার শাজাহানপুর থানার আব্দুর রহমান (৬৫) মারা যান৷ এ নিয়ে টঙ্গীতে দ্বিতীয় দফায় আসা চার মুসলি্লর মৃতু্য হলো৷টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্‍সা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জানান, গত বুধবার ইজতেমা ময়দানের শৌচাগারে অজ্ঞাত এক মুসলি্ল (৬৫) হঠাত্‍ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে পড়ে যান৷ পরে উপস্থিত লোকজন তাঁকে রাত পৌনে তিনটার দিকে টঙ্গী হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ সেখানে কর্তব্যরত চিকিত্‍সা কর্মকর্তা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন৷ ওই দিন রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্মীপুর সদরের দীঘলিয়া এলাকার মো. আবদুল কুদ্দুস (৬০) মারা যান৷  উর্দুতে দেওয়া মূল বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. নুরুর রহমান৷ পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় তা তরজমা করা হচ্ছে৷্বৃহস্পতিবার আসরের পর থেকেই ইজতেমা ময়দানে আগত মুসলি্লদের উদ্দেশ্যে ঈমান, আমল ও আখলাকের প্রাকবয়ান শুরু হয়৷তিন দিনের এ আয়োজনের প্রথম দিন শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজে অংশ নেয় মুসলি্লরা৷আগামী রোববার দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা৷  মুসলি্লদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ, আনসার ও র্যাব সদস্যসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন৷এছাড়াও সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়েজিত আছেন ইজতেমার নিজস্ব তাবলীগী স্বেচ্ছাসেবকরা৷

আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেলেও ইজতেমার বাকি আয়োজনে অংশ নিতে ট্রেন, বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, ট্যাঙ্ িও নৌযানে চড়ে এখনো মুসলি্লরা আসছেন ইজতেমা মাঠে৷বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও মুসলি্লদের আগমন অব্যাহত রয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার মুসলি্ল ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন৷  মুসলি্লদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে টঙ্গীতে দুই দফায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷এবছর মাঠে জেলাওয়ারি মুসলি্লদের অবস্থানের জন্য পুরো ময়দানকে ৩৯টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে৷ ৩৪টি জেলাওয়ারি জামাতবদ্ধ মুসলি্লরা এসব খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন৷প্রথম দফার চেয়েও দ্বিতীয় দফা ইজতেমায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. হারুন উর রশিদ জানিয়েছেন৷  তিনি বলেন,দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স এখানে মোতায়েন করা হয়েছে৷ এজন্য হরতাল-অবরোধেও ইতোমধ্যে লাখ লাখ মুসলি্ল ইজতেমা মাঠে এসে সমবেত হয়েছেন৷ তারা যতদিন এখানে থাকবেন ততদিন নিরাপত্তা দেওয়া হবে৷এসপি হারুন বলেন, রিভার পেট্রোল, ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরায় পুরো ময়দানের ওপর নজর রাখা হচ্ছে৷ এছাড়া বাইনোকুলার, হেলিকপ্টার টহল, মেটাল ডিটেক্টর, কন্ট্রোল রুমও স্থাপন করা হয়েছে৷ পুরো এলাকায় পোশাকে-সাদা পোশাকে পাঁচ স্তরে নিরাপত্তা নজরদারি চলছে৷

মুসলি্লদের যাতে কোথাও গাড়ি থামাতে না হয় এবং সবাই নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন সেজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থায় আগের চেয়েও বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷গাজীপুরের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট মো. শরিফুল ইসলাম জানান, ইজতেমাস্থল ও আশেপাশের অঞ্চলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে ওইসব অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়েছে৷এসব অঞ্চলে প্রতিদিন দুই পালায় পাঁচটি করে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন৷এদিকে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় যোগ দিতে এসে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত চার মুসলি্লর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ এদিকে মাঠে সার্বক্ষণিক বিদ্যুত্‍ ও পানি সরবরাহ এবং মুসলি্লদের চিকিত্‍সা সেবা দিতে বিনামূল্যে পর্যাপ্ত মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপনসহ টঙ্গীর সরকারি হাসপাতালে বিছানা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ হাসপাতালে রোগী স্থানান্তরে রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স৷ অগি্ননির্বাপনে থাকছে দমকল বাহনী ৷দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে বুুহস্পতিবার রাত পর্যন্ত মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ভারত, সুদান, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার মুসলি্ল ময়দানে সমবেত হয়েছেন৷

আয়োজক কমিটির মুরুব্বী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, ১৬০ একরের সুবিশাল ময়দানে জমায়েত সাধারণ মুসলি্লদের রান্না-বান্নার স্থায়ী ব্যবস্থা সম্ভব না হলেও মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণায় বিদেশিদের রান্নার জন্য গ্যাসসহ বিদ্যুত্‍ ও টেলিফোন সংযোগ এবং আধুনিক সুবিধা রয়েছে৷  ইজতেমা আয়োজকরা জানান, ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে ইজতেমার আয়োজন শুরু হয়৷ তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়৷এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমানস্থলে ইজতেমা হয়৷ পরে তুরাগ তীরের ১৬০একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয় সরকার৷