Falgun-1423764666

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি: দখিন হাওয়া, জাগো জাগো/জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।- প্রাণ জাগানিয়া কবি রবিঠাকুর বসন্তের দখিন হাওয়ায় এমনি করেই ভেসেছিলেন। আগমনী বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। শুক্রবার ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন ছিল। বাহারি পোশাকে সেজে শিশু-কিশোর, যুগল তরুণ-তরুণীদের সমাগম শুরু হয় ভোর থেকেই। পরিবার-পরিজনদের নিয়ে দল বেধে আসেন কেউ কেউ। সবারই গন্তব্য প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলা।এদিনেই অসংখ্য রমনী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত হয়ে উঠে। বসন্তের পূর্ণতার এ দোলা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র এবং সারা পৃথিবীর সকল বাঙালির ঘরে ঘরে। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরা পাতার শুকনো নুপুরের নিক্কন, প্রকৃতির মিলন, সব এ বসন্তেই।

তাই বসন্ত মানে পূর্ণতা। বসন্ত মানে নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানে একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের ঋতু বসন্তই মনকে সাজায় বাসন্তী রঙে, মানুষকে করে আনমনা। কবিও তাই ব্যক্ত করেছেন, ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।

বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে দোলা দেবে ফাগুন হাওয়া। শীতের জীর্নতা ভেঙে প্রকৃতিকে নতুন সাজে সাজাবে ঋতুরাজ। মধুময় বসন্তে ফুলেরসৌরভে মেতে উঠবে চারিপাশ। কোকিলের কুহুতান, মৌমাছিদের গুঞ্জরণ, মাতাল হাওয়া প্রাণে প্রাণে দেবে দোলা। শীতের আবরণে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া জেগে উঠবে সোনালি রোদের স্পর্শে। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে জানিয়ে দিল বসন্ত কড়া নাড়ছে দুয়ারে।যদি বলা হয় বসন্তের রং কি তাহলে সবাই বলবে বাসন্তী। হ্যাঁ, গাঁদা ফুলের রঙেই আজ সেজেছে তরুণ-তরুণীরা। পরেছে বাসন্তী রঙের শাড়ি। খোঁপায় গুজেছে ফুল আর হাতে পরেছে কাচের চুড়ি। তরুণরাও বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে নামবে বাংলার পথে ঘাটে।

শুধু শহরেই নয়, বাংলার গ্রামীণ জনপদেও আজ ঝিরি ঝিরি বাতাসে ধরা দেবে বসন্ত। বসন্ত শুধু উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন স্মৃতির কথাও মনে করিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ারও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

7fec54b15871f274a9d9030c69d3813b--1-বাঙালির জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বসন্ত। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে পহেলা ফালগুন-বসন্ত উৎসব হিসেবে। এ উৎসব এখন সব বাঙালির উৎসব। এই উৎসবটির একটি ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম ও উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই বসন্ত উৎসব শুধু একটা উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য।

বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে ঢাকায় বসন্ত উৎসব উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বসন্তের নাচ, গান ও কবিতার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ছিল দুই পর্বের অনুষ্ঠান।সকাল ৭টায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় উৎসব শুরু হয় যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনা। সকাল সাড়ে ৯টায় হয় বসন্ত শোভাযাত্রা। চারুকলা অনুষদ ছাড়াও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা ধরনের অনুষ্ঠান চলে।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আরও ছিল বসন্তকথন পর্ব, ফুলের প্রতিবন্ধনী বিনিময়, আদিবাসী পরিবেশনা, একক আবৃত্তি, দলীয় আবৃত্তি, একক সঙ্গীত, দলীয় সঙ্গীত ও বসন্ত আড্ডা। চারুকলায় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান চলে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান চলেিেবকাল ৪টা থেকে রাত পর্যন্ত।এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়-ভীতিকে পাশ কাটিয়ে অমর একুশে বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা এবং শাহবাগ এলাকা মেতেছে বসন্ত বরণে। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোররা মাতোয়ারা আজ বাসন্তি উচ্ছ্বাসে-আনন্দে।শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় শুরু হয় বকুল তলার বসন্তবরণ। তারুণ্য, নতুন এবং চির সুন্দরের আহ্বানে ফাগুনের প্রথম প্রহরে বসন্ত বন্দনা, বসন্ত কথন, ফুলের প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আবির বিনিময়, বসন্ত আড্ডায় বরণ করে নেওয়া হয় ঋতুরাজ বসন্তকে।

বরাবরের মতো এবারও জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ আয়োজন করেছে বসন্ত বরণ উৎসব-১৪২১।বেলা ১১টার দিকে বকুল তলা প্রাঙ্গনে বের হয় শোভাযাত্রা। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে গান পরিবেশনের মধ্যদিয়ে শেষ হয় এ শোভাযাত্রা।

এরপর ফের শুরু হয় দেশের গুণী শিল্পীদের গান, কবিতাসহ নানা আয়োজন। বাংলার সংস্কৃতির সবকিছু ফুঠে ওঠে এসব পরিবেশনায়। বয়স, শ্রেণি, পেশা সব কিছু দূরে ঠেলে দিয়ে সবাই যেন এক মঞ্চে। এমনই এক পরিবেশে শেষ হয় প্রথম পর্বের বসন্ত বরণ উৎসব।বসন্তের প্রথম প্রহর। গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুল তলা। তবে এ গন্তব্যে পৌঁছার আগে প্রথমে সবাই ঢু মারেন শাহবাগ মোড়ের ফুলের দোকানগুলোতে।

ফুলের সাজে নিজেকে সাজিয়ে চলে যান বকুলতলায়। বিভিন্ন ফুলের পসরা সাজিয়ে দোকানিদের প্রস্তুতিতেও কোনো ঘাটতি থাকে না। ফুলের এসব দোকানেও থাকে উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু এবার যেন একটু ব্যতিক্রমই দেখা গেলো ফুলের দোকানগুলোর দৃশ্য। গত বছরের তুলনায় ভিড় অনেকটাই কম ছিল।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফুল বিক্রেতা হাছান বলেন, এবার ক্রেতাদের সংখ্যা কম। গত বছর এ সময়ে ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন ভিড় হয়নি।’বিভিন্ন ফুলের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, আকার ও মানভেদে প্রতিটি জারবারা ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, গেলোডিয়াস ১৫ থেকে ২০ টাকা, গোলাপ ১৫ থেকে ২০ টাকা, রজনীগন্ধা ২০ থেকে ২৫ টাকা, ক্যাফেরোজ ৯০ থেকে ১১০ টাকা, গাঁদা ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

1_68817এছাড়া গাঁদা, গেলোডিয়াস ও রজনীগন্ধ ফুল দিয়ে ফুলের রিং তৈরি করে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকায়। আর বেলী ফুলের মালা কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা। শাহবাগ থেকে একেবারে বইমেলা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে আলতা-চুড়ি, আর ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকনীরা। ফুলের জলসায় মিলেমিশে যেতে কার না মন চায়! তাই অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিনে সাধ জাগলো দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বাংলা একাডেমি চত্বরে ঢোকার। কারণ ওই লাইনে যে ফুলের মেলা বসেছে।

বসন্তের প্রথম দিনে বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় আসার অনুভূতি জানাতে গিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়িক কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। তাছাড়া বড় মেয়েটি গুলশান-১ এর লেকহেড গ্লামার স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। সে কারণে চাইলেই সিডিউল মেলানো যায় না। তাই আজ ছুটি ও বসন্তের দিন এক সঙ্গে পড়ায় পুরো ফ্যামিলি নিয়ে মেলায় চলে এলাম।এদিকে পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ঘড়ির কাটা যখন ১১টার ঘর স্পর্শ করে ঠিক সেই সময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার দরজা এক সঙ্গে খুলে দেওয়া হয়। তবে শিশুদের বেশিরভাগ বইয়ের স্টল বাংলা একাডেমি চত্বরে থাকায় এখানেই ভিড় দেখা যায় বেশি।

নতুন এবং চির সুন্দরের আহ্বানে ফাগুনের প্রথম প্রহরে বসন্ত বন্দনা, বসন্ত কথন, ফুলের প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আবির বিনিময়, বসন্ত আড্ডায় বরণ করে নেওয়া হয়েছে ঋতুরাজ বসন্তকে।

এসো প্রাণের উৎসবে আহ্বানে যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় সকাল ৭টায় শুরু হয় এ উৎসবের। এরপর চলে বসন্ত বন্দনা। চলে গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, দলীয় সঙ্গীত,একক সঙ্গীতের পরিবেশনা। কীরণ চন্দ্র রায়, ফেরদৌস আরাসহ দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের পরিবেশনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা পরিবেশন করে বসন্তের গান, আবৃত্তি, নাচ।

উৎসবে এক এক করে গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ সহ বিভিন্ন কবি শিল্পীদের গান। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ধরেছি যে গান, ওরে ও গৃহবাসী খোল দ্বার খোল/লাগলো যে ওেদাল/জলে-স্থলে বনতলে লাগলো যে দোল.. ‘আহা আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে’ সহ অসংখ্য গান পরিবেশন করা হয়। তেমনি রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়াকেও তুলে ধরা হয়েছে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখী আমরা কিংবা ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতার মধ্যদিয়ে।

ফাগুনের প্রথম প্রহরে শাহবাগ, চারুকলা, টিএসসি এলাকায় বসন্ত বরণের আভাস অতোটা না পাওয়া গেলেও সকালের কাঁচাসোনা রোদে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসন্তি আমেজ পায় উৎসব প্রাঙ্গণ। হলুদ পাঞ্জাবি, শাড়ি পড়া তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরদের ভীড় বাড়তে থাকে বকুলতলার উৎসবে। নাচে-গানে দোল খায় মন, রোমাঞ্চ আর উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে চারুকলা প্রাঙ্গণ। ভালবাসা, সম্প্রীতির বন্ধনের পাশাপাশি চলে আবির বিনিময়।এছাড়া বাহারী পোশাকে শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা ছিল চোখে পড়ার মতো।বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বসন্ত কথন পর্বে বকুলতলার উৎসব মঞ্চে আসেন দুই বাংলার অতিথি শিল্পীরা। এসময় চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ও আহতদের প্রতি সম্মান এবং সমবেদনা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

বসন্তের পূর্ণতায় সব কালো আঁধার দূর করার আহ্বান জানিয়ে ওপার বাংলার (কলকাতার) সুরকার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় উদযাপন পরিষতের সহ-সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদের হাতে তুলে দেন দুই বাংলার মৈত্রী প্রতীক। মৈত্রী বিনিময়ের পর উদযাপন পরিষতের সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, বসন্তের পূর্ণতায় আমাদের দেশের সার্বিক সঙ্কট কেটে যাক। পেট্রোল বোমা আর আগুনের অপমৃত্যুর মিছিল থেকে মুক্ত হোক বাংলাদেশের পূণ্যভূমি।

এবারের বসন্ত উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে বার্জার পেইন্টস (বিডি) বাংলাদেশ।আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চরুকলায় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এছাড়াও রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্ক, লক্ষ্মীবাজার, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ এবং উত্তরার ৩ নং সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে বসন্ত বরণের নানা আয়োজন করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান চলবে বিকেল ৪টা থেকে চলে রাত পর্যন্ত।