বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সংবিধান,আইন ও প্রথাবিরোধী’ আচরণ করছেন বলে আবারও অভিযোগ করেছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।তিনি বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর যেসব রায় ও আদেশ তিনি লিখেছেন, তা জমা দিতে চাইলেও প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার কারণে তা নেওয়া হয়নি। অবসরে যাওয়ার পর লেখা সেসব রায় ও আদেশ গ্রহণ করতে রোববার প্রধান বিচারপতির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন চার মাস আগে অবসরে যাওয়া এই বিচারক। সেই চিঠিতেই এসব অভিযোগের কথা এসেছে। প্রধান বিচারপতিকে তিনি লিখেছেন, আমি ইতিপূর্বে আপনাকে অবহিত করেছি যে, আপনার এরূপ আচরণ সংবিধান, আইন ও প্রথাবিরোধী ও একই সাথে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। রোববার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ওই চিঠির বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের সামনেও তুলে ধরেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।

অবসরে যাওয়ার পর হাতে লেখা রায় ও আদেশগুলো গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। তিনি দাবি করেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে এগুলো গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।গত ৪ ফেব্র“য়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কাছে তিনি এই চিঠিটি দেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় বলছে, এ ধরনের কোনো চিঠি তারা হাতে পাননি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর কাছে যেসব মামলার রায় ও আদেশ লেখা বাকি ছিল তা তিনি শেষ করেছেন। এ জন্য তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার কাছে এগুলো নেওয়ার অনুরোধ জানান। তবে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা সেগুলো গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতির নির্দেশ অনুসারে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির লেখা রায় ও আদেশ গ্রহণ করা যাচ্ছে না।চিঠিতে আরও বলা হয়, শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরে যাওয়ার পর তাঁর কার্যালয় তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে। সব অফিস স্টাফ ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ জন্য তিনি রায়গুলো টাইপ করতে পারেননি।

প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ১৯ জানুয়ারি দেওয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান বিচারপতি বাণীতে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তাঁর গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। এই বক্তব্যের সূত্র ধরে আইন অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। প্রধান বিচারপতিকে তিনি লিখেছেন, আমি ইতিপূর্বে আপনাকে অবহিত করেছি যে, আপনার এরূপ আচরণ সংবিধান, আইন ও প্রথাবিরোধী ও একই সাথে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ওই চিঠির বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের সামনেও তুলে ধরেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।

বিচারপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন লিখেছেন, আমার প্রিজাইডিং জজ, মাননীয় বিচারপতি জনাব মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়াকে আমার লেখা সমাপ্ত হওয়া রায় ও আদেশগুলো গ্রহণ করার অনুরোধ করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বলেন যে, মাননীয় প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুসারে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির লিখিত রায় ও আদেশ গ্রহণ করা যাচ্ছে না।অবসরের পর বৈষম্যমূলকভাবে তার অফিস তালাবন্ধ করে দেওয়ায় এবং অফিসের সব কর্মী ও সুবিধা থেকে তাকে বঞ্চিত করায় হাতে লেখা রায়গুলো টাইপ করতে পারেননি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তিতে গত ১৭ জানুয়ারি এক বাণীতে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি। তার ওই বক্তব্য নিয়ে দেশে নানামুখী আলোচনার বিষয়টিও বিচারপতি শামসুদ্দিনের চিঠিতে এসেছে। এ বক্তব্যের উপর ইতিমধ্যে মহান সংসদে আলোচনা হয়েছে এবং সংসদ আপনার বক্তব্যের সহিত দ্বিমত পোষণ করেছেন ও বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই এবং এটা অসাংবিধানিক নয়’ মর্মে মন্তব্য করেছেন।প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, অবসরের পর রায় লেখার দীর্ঘদিনের এই চর্চায় তারা কোনো সমস্যা দেখেন না।আর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তিনিও ঘোষিত রায় পরে লেখা বেআইনি মনে করেন না।

আইনজ্ঞদের এ মতামতের প্রসঙ্গ টেনে বিচারপতি শামসুদ্দিন প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, আপনার ব্যক্তিগত মতামত ও বিশ্বাসের জন্য আপনি বিচার ব্যবস্থা আইন ও প্রথাকে অস্বীকার করতে পারেন না। কারণ আপনি সাংবিধানিক শপথ নিয়েছেন।নিজের শুনানি করা রায় ও আদেশ লেখার কাজ শেষ করেছেন জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে তিনি সেসব রায় ও আদেশ গ্রহণের যথাযথ ব্যবস্থা’ নিতে বলেছেন।ওই চিঠির অনুলিপি আইনমন্ত্রী ও আপিল বিভাগের অপর বিচারকদেরও পাঠানো হয়েছে।২০০১ সালের ৩ জুলাই বাংলাদেশের হাই কোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়া শামসুদ্দিন চৌধুরী গতবছর ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার সময় ১৫টি রায় ও ৭০টি আদেশ লেখা বাকি ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। রোববার তিনি বলেন, আমার সব স্টাফ উইথড্র করা হয়েছে। তাই আমি আমার একজন লোকের মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সেদিন দেরি হয়ে যাওয়ায় উনি মনে হয় ওটা পাননি। তাই আজ সকালে আবার আমি চিঠি পাঠিয়েছি।

অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার এক বক্তব্যের পর দেশে নানামুখী আলোচনা চলছে। তার মধ্যেই হাতে লেখা রায় নিতে প্রধান বিচারপতিকে এই চিঠি দিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তিতে সেদিন এক বাণীতে বিচারপতি সিনহা বলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি।তার যুক্তি, বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের শপথের কার্যকারিতা থাকে না বলে তারা রায় লেখার অধিকারও হারান। ওই ভুল আর করতে দেবেন না বলেও পরে আরেক অনুষ্ঠানে জানান প্রধান বিচারপতি।

তার ওই বক্তব্যে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি তাদের সমর্থক আইনজীবীরা জোর সমর্থন দিয়ে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ও অবৈধ প্রমাণিত হয়েছে।অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে ওই বক্তব্য এসেছে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে। তবে ঘোষিত রায় পরে লেখা বেআইনি মনে করছেন না তিনি।বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও বলেছেন, বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখার দীর্ঘদিনের এই চর্চায় কোনো সমস্যা তারা দেখেন না।এই আলোচনার মধ্যেই গত ২৯ জানুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও ছিলেন।তবে ওই নৈশভোজের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি।গত বছর ১ অক্টোবর অবসরে যাওয়ার সময় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ১৫টি রায় ও ৭০টি আদেশ লেখা বাকি ছিল। সেগুলো প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তিনি বলেছেন, সহযোগিতার জন্য এখন কোনো কর্মী না থাকায় রায়গুলো হাতেই লিখতে হয়েছে।অবসরের আগে বিচারপতি শামসুদ্দিন আপিল বিভাগের যে বেঞ্চে দায়িত্বরত ছিলেন, সেই বেঞ্চের ‘প্রিজাইডিং জাজ’ হিসেবে আছেন বিচারপতি এম ওয়াহাব মিয়া।ওয়াহাব মিয়ার মাধ্যমে ওই রায়গুলো গ্রহণ করতে বলেছি চিঠিতে, বলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী ।