14-04-16-Pohela Boishakh-1

পহেলা বৈশাখের নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী সেজেছিল লাল-সাদা রঙ্গে।তরুণ-তরুণ, শিশু-কিশোরদের পদচারণায় মুখোরিত ছিল চারুকলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো। নাচ, গান, নাগরদোলায় চড়ে বেড়িয়েছেন তারা।এদিকে, নিজেদের উৎসবকে সংকীর্ণ না করে অশুভ শক্তির মোকাবেলা করার আহবান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ আহবান জানান তারা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রাজধানীর নির্ধারিত স্থান ও সড়কগুলোতে শুরু হয়ে যায় বর্ষবরণের উৎসব।চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল নববর্ষের লাল-সাদার ছোঁয়া। একা বা দলবেঁধে, অনেকের সঙ্গেই নেই চেনা-জানার বালাই। সার্বজনীন উৎসব বলেই সবাই মিলে এক মিলনযজ্ঞ।প্রতিটি উৎসবের মতো পহেলা বৈশাখেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ শিশুরা। হরেক রকম খেলাধুলার উপকরণ পেয়ে উচ্ছ্বসিত তারা।বাংলাদেশে কাজের কারণে বা ঘুরতে আসা, যাই হোক, বাংলা সনের প্রথম দিনের উৎসবে একাত্ম হতে কোন অংশ কম নয় বিদেশি বন্ধুরাও।
বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো কৃষ্টি-কালচারে পহেলা বৈশাখ পরিণত হয়েছে প্রাণের উৎসবে। এ দিনটিতে পুরনোর জীর্ণতা, গ্লানি- ভেদ ভুলে নতুনকে আহ্বান করে বাঙালি। সারাদেশে বিরাজ করে উৎসব মুখর পরিবেশ। এদিনে নানা আয়োজনে আপামর বাঙালি বরণ করে নেয় বাংলা নববর্ষকে।বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়িত রুপ ফুটে এ উৎসবের মাধ্যমে। তাইতো বাঙালির এ প্রাণের উৎসব নববর্ষকে বরণ করে নিতে রমনার বটমূলে ছায়ানটের কবিগুরু রবী ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো… সুরের তালে তালে বর্ষবরণের ঢেউ লাগে এদেশের কোটি বাঙালির মানসপটে। আর বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছে হাজারো মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মহাকর্মযজ্ঞ।বিশাল টেপা পুতুলে মা ও শিশুর অবয়ব ফুটিয়ে তুলে অবক্ষয়ের পৃষ্ঠা উল্টে নবজাগরণের ডাক এসেছে এবারের বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায়।অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে- প্রার্থণায় বঙ্গাব্দ ১৪২৩ কে বরণ করে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রতিবারের মতো এবারও এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে।বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় শোভাযাত্রা। শাহবাগ দিয়ে রুপসী বাংলার মোড় ঘুরে টিএসসি হয়ে ফের চারুকলার সামনে এসে এই বর্ণিল যাত্রার শেষ হয়।সামনে- পেছনে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে নৃত্য, আর হাতে হাতে ধরা বড় আকারের বাহারি মুখোশ। টেপা পুতুল আর বাঁশের কাঠামোতে মাছ, পাখি, হাতির মতো নানা লোকজ মোটিফে ফুটে উঠেছে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য।সেই প্রতীক আবার ধারণ করেছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের চিহ্ন, অমঙ্গলের আঁধার ঘোচানোর প্রত্যয়।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে চারুকলা অনুষদের সামনে জমায়েত হতে থাকে হাজারো মানুষের। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে উপস্থিতি। ৯টা বাজতেই শাহবাগ থেকে টিএসসি এলাকা বৈশাখের রঙে রঙিন মানুষের পদভারে ভরে ওঠে।ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৯টা বেজে ১২ মিনিট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক, প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হোসাইন, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের নেতৃতে চারুকলা থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি রুপসী বাংলা হোটেল চত্বর হয়ে হয়ে টিএসসি হয়ে আবার চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়।শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। এতে তরুণদের অংশ নিতে দেখা গেল বৈশাখী পাঞ্জাবি আর মাথায় গামছা যাতে লেখা ছিল এসো হে বৈশাখ। তরুণীরা পরিধান করে বৈশাখী শাড়ি। ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে রংতুলি দিয়ে লেখা শুভ নববর্ষ। এছাড়া বাঙালির উৎসবের এ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন অনেক বিদেশি পর্যটক।এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল মা ও শিশুকে চেতনায় ধারণ করে ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে’। ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাতে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল ৯টি ভাস্কর্য। এর মধ্যে বিশাল আকৃতির একটি কাঠামোয় দেখা যায় একজন মা পরম যতেœ তার দুই হাত দিয়ে শূন্যে তুলে ধরে আছেন স্নেহের শিশুকে, যা প্রকাশ করছে মা ও সন্তানের মধ্যকার চিরায়ত মধুর সম্পর্ক।আরেকটি ভাস্কর্য পাখি এবং একটি গাছ সঙ্গে একটি ফুলের সমন্বয়, যা দ্বারা সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের অপরূপ রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছিল জাতীয় সমৃদ্ধিও প্রতীক হাতি। আরও ছিল নৌকা’ প্রতীক, যে প্রতীক সামনে রেখে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া নৌকা এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত। হরিণ ভাস্কর্যটি দিয়ে বাংলাদেশের অনন্য সম্পদ সুন্দরবনকে তুলে ধরা হয়। আর একটি ঐতিহ্য হলো মাটির তৈরি ঘোড়া। এ ছাড়া ছিল ‘ষাঁড়ের’ ভাস্কর্য। যা দিয়ে জঙ্গিবাদসহ সব অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন, যারা এ দেশের সম্মানহানি করতে চায় তাদের প্রতি প্রতিবাদস্বরূপ জানানো হয়।নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এবারের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ভুভুজেলা ও মুখোশ পরা নিষিদ্ধ করা হয়। যার কারণে শোভাযাত্রায় কাউকে মুখোম পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়নি। মুখোশ ছিল হাতেই। এসব মুখোশের মধ্যে ময়ূরসহ ছোট ছোট পাখি, দু-একটি বাঘ ও পেঁচার মুখোশ লক্ষ্য করা যায়। শোভাযাত্রা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আমরা আমাদের চিরচারিত ঐতিহ্য অক্ষুণ্ধসঢ়;ণ রাখছি। এর মুল লক্ষ্য হচ্ছে বাঙালি জাতি এবং বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনা করা। আমরা প্রতিবছর এ শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য পরিবর্তন করি। এবারের স্লোগান হচ্ছে ‘মা ও শিশু’। শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবী এগিয়ে চলছে। সন্তান জন্মদান পরিচর্যা প্রতিপালনে মায়ের রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা সেটিকে সম্মান জানানো শ্রদ্ধা জানানো। আর মা বলতে শুধু মানবজাতিকে বোঝাচ্ছি না। সকল জীবজগতের সকল প্রজাতির শিশু এবং তাদের মা এতে অর্ন্তভুক্ত। তাদের ধারাবাহিকতায় পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। এ উদ্দেশে আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করেছি।তিনি বলেন, আর এতে ঢাকা শহরতো বটেই বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছে। বাঙালি জাতির ঐক্যের অবস্থান হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। এখানে ধর্ম-বর্ণ স্থান অথনৈতিক অবস্থান কোন ধরনের পার্থক্য নেই। আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যারা অন্য ভাষায় কথা বলে তাদেরও বর্ষবরণের উৎসব হচ্ছে। বৈশাখী বৈসাবি একাকার হয়ে আছে। এর মাধ্যমে আমরা ১৪২২ কে বিদায় জানালাম ১৪২৩ সালকে স্বাগত জানালাম।এদিকে শোভাযাত্রায় গত বছরের বর্ষবরণে নারী নিপীড়নের মতো ঘটনা ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। শোভাযাত্রার সামনে র‌্যাব এর দুইটি গাড়ি, এর পরে ডিএমপির বোম ডিসপোসাল ইউনিটের সদস্যরা। তারপরে ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও সোয়াতের সদস্যরা। এছাড়া র‌্যব সদস্যদের হেলিকপ্টারে করে টইল দিতে দেখা যায় । শোভাযাত্রার বিশাল ময়ূরপঙ্খী নাও নদীমাতৃক বাংলাদেশের সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে এসেছে। দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখিয়েছে একরোখা ষাঁড়। গাছ আর পাখি, গরুর শিল্প-কাঠামো মনে করিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি আর পরিবেশের প্রতি দায়িত্বের কথা।
বর্ষবরণের এই শোভাযাত্রা এরইমধ্যে বাঙালির বর্ষবরণের কেন্দ্রীয় আয়োজনের একটি হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, নেচে- গেয়ে তাতে অংশ নিয়েছেন সব বয়সের সব শ্রেণি- পেশার হাজারো মানুষ। বৈশাখের লাল-সাদার ভিড়ে দেখা গেছে বিদেশি মুখও। আয়োজকরা জানান, গত বছরজুড়ে শিশুহত্যা, মা ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্কে অবনতি আর ধর্মান্ধ শক্তির আস্ফালনের প্রেক্ষাপটে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম হিসেবে তারা বেছে নেন সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। শোভাযাত্রার নিরাপত্তা দিতে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসির সদস্যরাও ছিলেন।মুখে মুখোশ এঁটে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবার। তবে চারুকলার বানানো বড় মুখোশ ছিল হাতে হাতে।শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে বৃহস্পতিবার রমনার বটমূলে চলে ২ ঘণ্টার সুরের মূর্চ্ছনার আয়োজন। সকাল সোয়া ৬টায় রমনার বটমূলে ভোরের আলো রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নীরবতা ভাঙলেন শিল্পী অভিজিৎ কুণ্ডু ও সুস্মিতা দেবনাথ শুচি। সেতার পরিবেশন করলেন রাগ পরমেশ্বরী। খুব ভোরেই মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ। এরপর ছায়ানটের শিল্পীরা পরিবেশন করেন জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের গান জাগো সকল অমৃতের অধিকারী’। শিল্পী সত্যম কুমার দেবনাথের একক গান আমি কেমন করিয়া জানাবো, এরপর সম্মিলিত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা পরিবেশন করেন-ওই মহামানব আসে।পরিবেশনার ধারাবাহিকতায় শিল্পী এটিএম জাহাঙ্গীরের পরিবেশনা এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে শিল্পী সেঁজুতি বড়ুয়া সহজ হবি সহজ হবি, শিল্পী সুমন মজুমদারের কোন কুসুমে তোমায় আমি’ শিল্প হেমন্তী মঞ্জরীর সবারে বাস রে ভাল।আবার শুরু হয় ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মিলিত পরিশেনা হবে জয়, হবে জয়। এরপর আবৃত্তিকার তাপস মজুমদারের আবৃত্তি ‘দ্বারে বাজে ঝঞ্চার ঝিঞ্চির। এভাবে ৩টি আবৃত্তি, ১৫টি একক গান, ১২টি সম্মেলক ও পাঠ দিয়ে সাজানো অনুষ্ঠানের সমাপনী হয় ছায়ানটের সহ-সভাপতি ড. সারওয়ার আলীর শুভেচ্ছা কথনের মাধ্যমে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন দেড়শ শিল্পী। আবার বড়দের দল পরিবেশন করে আনন্দ ধ্বনি জাগাও গগনে। এরপর একে একে লাইসা আহমদ লিসা পরিবেশন করেন বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে। এছাড়া চন্দনা মজুমদার, আফসারা রুনা, দেওয়ান সাইদুল হাসান প্রমুখ শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
এদিকে, নববর্ষ বরণকে ঘিরে রমনার বটমূল ও তৎসংলগ্ন এলাকা ছিল কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে। সোয়াত, র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি ছিল ছায়ানটের অনুষ্ঠানকে ঘিরে। রমনা উদ্যানে প্রবেশের প্রতিটি পথে দেখা গেছে তল্লাশি কেন্দ্র। মূলত এই গানের মধ্য দিয়ে শুরু ছায়ানটের ৪৯তম গানে গানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা ৩২ মিনিট। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন শেষ হয়। এদিকে, বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র-চত্বরে আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এতে অংশ নেয় বিশিষ্টজনেরামুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে নববর্ষের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় বিভিন্ন শিশু সংগঠন। নববর্ষ উৎযাপনে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতেও আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে নাচ-গান পরিবেশন করেন শিশু শিল্পীরা।এদিকে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দিনব্যাপি বৈশাখী আয়োজনেও শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।নববর্ষের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে রাজধানীর বিভিন্ন বাসা-বাড়িতেও আয়োজন করা হয়েছে নানান অনুষ্ঠান। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘরোয়া এই আনন্দ-আয়োজন ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নগরজীবনে। বৃহস্পতিবার পহেলা বৈশাখ শুভ নববর্ষ, স্বাগত ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। শুরু হলো বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের দিন গণনা। বাঙালির প্রধানতম সম্প্রীতির উৎসব এ বৈশাখ আবাহন।ষাটের দশকে এ বাংলা জনপদ যখন পাকিস্তানের নিগড়ে, আইয়ুবী আমলে সাম্প্রদায়িক বিজাতীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনে বিপন্ন যখন বাঙালির উৎসব, সেই থেকে বৈশাখ আসে নবআনন্দে ওঠার শক্তি নিয়ে।এরপর দিন বদলেছে, পরাধীনতা ছিঁড়ে ফেলে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। উৎসব-পাগল বাঙালি মিশে গেছে আবহমান বাংলার চিরায়ত ফসলকেন্দ্রিক উৎসব-আনন্দে। সাফল্য, সমৃদ্ধি আর মঙ্গল কামনায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয় সকলেই।
কৃষিপ্রধান এ জনপদে সুষ্ঠ্ধুসঢ়;ভাবে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন দরকার ছিলো আগে থেকেই। চান্দ্র আর সৌরসনে আটকা পড়া বর্ষপঞ্জি যেন সে চাহিদা মেটাচ্ছিল না। সেই চিন্তায় ভারতবর্ষে মুঘল আমলে সম্রাট আকবরের সময়ে কার্যকর হলো ফসলি সন’। কালক্রমে সেটাই বাংলা সন, বঙ্গাব্দ। প্রাচীন নববর্ষের রূপটি আজো আধুনিক নববর্ষ উৎসবের মধ্যে বয়ে চলেছে। চৈত্রের শেষ, বৈশাখের শুরু। পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনের বারতা নিয়ে এসেছে প্রকৃতি। ফাঙ্গুন থেকেই পুরনো পাতা ঝেড়ে নতুন পাতায় সাজতে শুরু করেছে গাছগুলো। বৈশাখে পূর্ণতা নিয়ে চকচকে সবুজ নতুন পাতায় নতুন বছরকে স্বাগত জানানো তাই চিরায়ত।
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য এ দুই মাস গ্রীষ্মকাল প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত মানুষ, একটু শান্তির আসায় বিশ্রাম তটিনীতলে। বাংলা জনপদের মানুষের প্রাণের উৎসব, নতুন বছরের প্রথম দিন এই পহেলা বৈশাখ। ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতার ঊর্ধ্বে অসাম্প্রদায়িক এ উৎসব-আয়োজন।সময়ের বিবর্তনে এখন ক্লান্তি মেটানো ডাবের পানির জায়গা নিয়েছে কোমল পানীয়। তবু প্রচণ্ড এ গরমে স্বস্তি পেতে এখনো বাঙালি ভুলে যায়নি তার কৃষ্টি-সংস্কৃতি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বর্ষবরণের সব উপকরণ নিয়ে চৈত্রের শেষদিকেই জমে ওঠে কেনাবেচা।তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এ উৎসব বাঙালির, বাংলাদেশের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলে সম্ভবনার নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব।বাঁকা বাঁশের বাঁশরী’ নিয়ে হাজার বছর পেরোনো বাঙালি গত ক’টি বছরে ভুলেছিল পথ। কানাইয়া- চৌরাশিয়া সুর ভুলে এ জাতি মেতেছিল ভুভুজেলা নামক বেনিয়া যাতনায়। তবে আইনি বাঁধনে আর সার্বজনীন সচেতনতায় পাল্টে গেছে এবারের চিত্রপট।
এবারের পয়লা বৈশাখের উৎসবে রাজধানীর তপ্ত রাজপথে ঘর্মাক্ত হাতগুলোতে ভুভুজেলা খুব একটা চোখে পড়েনি। উৎকট কোনো শব্দে পিষ্ট হয়নি আবাল বৃদ্ধ বণিতার কর্ণ মাধুরী। রবি নজর“লের শ্বাশত গানে, বাউল জারি সারির উদ্দিপ্ত সুরে মেতেছে আবার আবহমান বাংলা।দুপুর পর্যন্ত নগর উৎসবের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাতীয় সংসদ ভবন, ধানমণ্ডি লেক ঘুরে ভুভুজেলা তেমন চোখে পড়েনি।গত বছর যে হাতগুলো এ শব্দ দানবের দখলে ছিল, এবার সেসব হাতে রাঙা মুখোশ, বাহারি মালা। অনেকে হাতে সেই বাঁশের বাঁশি যেনো মেলা থেকে এক টাকার ভেঁপু কিনে ফিরছে পল্লী সন্তান।
হৈ হুল্লোড় আছে, ঢোল বাদ্য বেজে চলছে, হরেক রকম দেশি বাঁশির শব্দ ব্যঞ্জনা আছে, তবে গত বছরের মতো যন্ত্রণা নেই। কর্ণপীড়ামুক্ত এক নান্দনিক মিছিলের সেআত দগ্ধ রোদ উপেক্ষা করে ছুটছে প্রাণের আহ্বানে। পথপাশের মাদুর বিছানো হরেক পসরার মাঝেও ভুভুজেলা নেই। হাইকোর্ট চত্বরে একজন ফেরিওয়ালাকে ভয়ার্ত চোখে গুটি কয়েক ভুভুজেলা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে কিন্তু তারও বিকি-কিনি তেমন নেই।ঘেমে নেয়ে একাকার মিরপুর থেকে আগত তন্বী জানালেন তার প্রশান্তির কথা। বললেন, ভুভুজেলানেই, যন্ত্রণা নেই, কি যে ভালো লাগছে। গত বছরও কত বিরক্তিকর ছিল এ উৎসব- শুধু ভুভুজেলার কারণে।নলখাগড়া বা বাঁশের বাঁশির ঐতিহ্য মণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছিল আফ্রিকার ভুভুজেলার কাছে। উৎকট এ শব্দ যন্ত্রনা ২০১০ এ দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের পরই দুনিয়া জুড়ে পরিচিত পায়। এরপর ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভুভুজেলা যন্ত্রটি এদেশের সবার কাছে ব্যাপক জনপ্রি হয়ে ওঠে। ক্রিকেটভক্তদের হাতবদল করে আস্তে আস্তে তা দখল করে নেয় ছোট-বড় সব উৎসব। এমনকি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিলন মেলা বাংলা বর্ষবরণেও ভুভুজেলা ছড়িয়ে পড়ে হাতে হাতে।

এতে উৎসবে আসা মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় ছন্দপতন হচ্ছিল। ভিড়ের মাঝেই একা একা, বা দল বেঁধে সমস্বরে চারপাশ কম্পিত করতো ভুভুজেলা বাদকেরা। এরপরই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিদেশি আগ্রাসনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সচেতন জনতা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বোশেখ উৎসবে ভুভুজেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ৷ ফলে বাঙালি আবার মেতে উঠছে চৌরাসিয়ার সুরে।দোয়েল চত্বর হয়ে তোপখানা রোড ধরে ফিরতে ফিরতে কল্পনা বিলাসী মন যেনো শুনতে পায় মেঠো পথ ধরে ভেসে আসা মাটির সুর -আজো মধুর বাঁশরী বাজে … গোধুলী লগনে বুকের মাঝে…।পহেলা বৈশাখে আর বছরের মতো জমেনি রমনায় পান্তা-ইলিশের বিকিকিনি। নববর্ষ আয়োজনের মূল এ কেন্দ্র ঘিরে গত ক’বছর ধরে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল মৌসুমি এ ব্যবসা। অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বটমূলের কিছুটা দূরে বসে এ আয়োজন। বসে রমনার বাইরেও।বৃহস্পতিবার রমনার উদ্যানের ভেতরে-বাইরে ঘুরে দেখা গেছে পান্তা-ইলিশ বিক্রির দোকানের সংখ্যা কম। পাশাপাশি এসব দোকানে ভোজনবিলাসীদের সংখ্যাও হাতেগোনা।বটমূল থেকে বেশ দূরে কাকরাইল মসজিদের সামনে অস্থায়ী একটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে পান্তা-ইলিশ। প্রতি প্লেট ১০০ টাকা। নববর্ষে রমনায় আগতরা এ খাবারের প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছে না। জানালেন পান্তা-ইলিশ বিক্রিতা আব্দুল হালিম।বিক্রেতা জানান, সকালে মৎস ভবন এলাকায় পান্তা ইলিশ নিয়ে বসলে পুলিশ সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরে এখানে এসে বেচাকেনা শুরু করি। কিন্তু গেলবারের মতো সাড়া পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।তবে রমনা উদ্যানের ভেতরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চলছে ইলিশ প্যাকেজ। এতে আছে ভাত, খিচুড়ি কিংবা পোলাওয়ের সঙ্গে এক টুকরো ইলিশ,পানি কিংবা কোমল পানীয়। এ প্যাকেজের দাম নেয়া হচ্ছে ৪৫০ টাকা।এদিকে বৈশাখের প্রথম দিনে ঘটা করে পান্তা-ইলিশ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ বলছেন, পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা ইলিশ বাঙালি রীতির অংশ, আবার কেউ বলছেন, বাঙালির ঐতিহ্যে এমনটা কখনও ছিল না। তবে যে যাই বলুক, পান্তা-ইলিশের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই কিছু ব্যবসায়ি চড়া দামে ইলিশ বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের মুনাফা।রমনায় আগতদের অনেকেই এ প্রতিবেদককে জানান, আসলে নববর্ষে পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের ঐতিহ্যের অংশ নয়। আগে এ নিয়ে এতটা মাতামাতি হতো না। গত দুই-তিন বছর ধরে কিছু মুনাফালোভী সিজনাল ব্যবসায়ি নববর্ষ নিয়ে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে চড়া দামে ইলিশ বিক্রি করছে ।