03-06-16-CPD_Press Confe-4

অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হলেও আয় ও ব্যয়ের কাঠামো এবং ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনায় দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ।শুক্রবার বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনায় সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার প্রতিষ্ঠানের এই মতামত তুলে ধরেন।প্রতি বছর বাজেটে বাড়তি প্রাক্কলন এবং অর্থবছর শেষে তা অর্জন করতে না পারার মধ্য দিয়ে আস্থার সঙ্কট তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়।প্রস্তাবিত বাজেটকে অস্বস্তি মূলক স্বস্তির বাজেট বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণ জনগণের জন্য সরকারের এই বাজেট অস্বস্তিমূলক স্বস্তির বাজেট।শুক্রবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে সিপিডি আয়োজিত জাতীয় বাজেট ২০১৬-১৭ সিপিডির পযালোচনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে এ সময় সিপিডির নিবার্হী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান সহ সিপিডির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ঐতিহাসিক, বিশাল ও সাহসী বাজেট বলে মনে করেন অনেকেই, বাস্তবে সেরকম নয়।টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বড় হয়েছে কিন্তু দেশের অর্থনীতির তথা জিডিপির তুলনায় বাড়েনি। এই বাজেট জিডিপির ১৪ শতাংশ। যা বাস্তবে শতাংশের আকার ১৭ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারতো।বাজেটে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেসব পরিকল্পনার সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি বলেন, পরিকল্পনা ঠিক আছে কিন্তু বাজেটের আয় ও ব্যয়ের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, বাস্তবে এই তীর ও ধনুকের (আয় ও ব্যয়) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাধারণত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে উন্নয়ন ব্যয় বাড়নো দরকার। কিন্তু আমাদের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় তুলনামূলক অনেক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি লক্ষ্য করা গেছে।বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় বেশি বরাদ্দ রাখা দরকার বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারণে এবারের বাজেট প্রণয়ন তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়েছে। তাই সরকার বাজেট বড় করতে পেরেছে। তবে বাজেটে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান তৈরিসহ অনেক খাতের জন্য ইতিবাচক পরিকল্পনা অনুপস্থিত থাকায় বাজেট বাস্তবায়ন কষ্টস্বাধ্য হয়ে যাবে।তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবির থাকার পরও প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বেসরকারি খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ বাড়াতে হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা বাস্ত বে সম্ভব হবে না। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। এই মন্দা বাজারে ১৩ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংক খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। এই টাকা বিনিয়োগের আগে পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতের লুপটাট বন্ধ করতে হবে। নিয়ম নীতি ঠিক করে তারপর বিনিয়োগ করা যেতে পারে, তা না হলে করের এই টাকা লুট হয়ে যাবে।কর আহরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দেবপ্রিয় বলেন, সরকারের যে কর আহরণ নীতি রয়েছে তার পরিবর্তন করতে হবে। নতুন করে করের আওতা বাড়াতে হবে। পুরনো ব্যক্তিদের ওপর চাপানো বোঝা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, সাংধানিকভাবে কালো টাকা তথা অপ্রদর্শিত আয়ের যে বিধান রয়েছে তা আমরা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি। কিন্তু এই টাকা দেশের অর্থনীতিতে আনতে কেবল অর্থদণ্ড নিয়ে আবাসন খাতে বিনিয়োগের যে বিধান রাখা হয়েছে তার সঙ্গেও আমরা একমত। তবে আবাসন খাতের পাশাপাশি শিল্প খাতেও শর্তসাপেক্ষে কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা রাখা যেতে পারে। কারণ দেশের শিল্প খাতের অবদান এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই এ খাতের অবদান দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি।অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেটকে কেউ কেউ ‘বড় বাজেট বা ঐতিহাসিক বাজেট’ বললেও তার সঙ্গে একমত নন’ জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, প্রতি বছর বাজেট টাকার অংকে বাড়লেও মোট অর্থনীতির শতকরা হারের হিসাবে সেই ১৪ শতাংশেরই আটকে আছে, আর বাড়ছে না।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তার শিক্ষা, প্রযুক্তি, জনসেবা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন, কর ও শুল্ক কাঠামোতে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টার প্রশংসা করেছে সিপিডি।কিন্তু সেইসঙ্গে বিদেশি সাহায্য ব্যবহার, এডিপি বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর আহরণের কৌশল নিয়ে বাজেটে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি জানিয়ে অতি প্রাক্কলনের প্রবণতার সমালোচনা করা হয়েছে।দেবপ্রিয় বলেন, যদি একটি নীতি ঘোষণা করা হয় এবং সেই নীতি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে পরবর্তী নীতিটি যখন ঘোষিত হয়, সেটা বাস্তবায়নের জন্য যে চলকগুলো থাকে, যে ফ্যাক্টরগুলো থাকে- প্রশাসনের ভেতরে, প্রশাসনের বাইরে, তারা সেটার ওপর আস্থা কম রাখে। কারণ এরকম ঘোষণা তো অনেকবারই হয়। কোনো নীতি ঘোষণার পর তাতে আস্থা পেতে হলে ওই নীতিকে আরও ‘নির্দিষ্ট’ ও ‘শক্তিশালী’ হতে হয় বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়।তিনি বলেন, অনেকে বলছেন বেশি পরিমাণে প্রক্ষেপণ করি যদি কিছু হয়, হিসেব করে যদি প্রক্ষেপণ করতাম তাহলে ওইটুকু করারও আগ্রহ থাকত না। আমরা এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করি না।কারণ আপনার যদি প্রক্ষেপণে বিশ্বাস না থাকে, প্রক্ষেপণের সেই অর্থে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেলে নীতির দক্ষতা নষ্ট হয়ে যায় এবং তখন কেউই তা গুরুত্ব সহকরে গ্রহণ করে না।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে দেবপ্রিয় বলেন, সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায় সাড়ে ৮০ শতাংশ অর্জিত হলেও বাংলাদেশে হয় ৭৩ শতাংশ। ভারত যেখানে কর আদায়ে লক্ষ্যের ৯৩ শতাংশ পূরণ করতে পারে, সেখানে বাংলাদেশে হয় ৮০ শতাংশের নিচে। প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারত ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করে, আর বাংলাদেশ করে সাড়ে ৮১ শতাংশ।বাজেটের আকার নিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, আপনারা শোনেন যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে, বড় বাজেট হচ্ছে। বাজেট তো বড় হবে, অর্থনীতি বড় হলে বাজেট বড় হবে। কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবং ব্যয়ের পরিমাণও বড় হবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু দেশের অর্থনীতি যেভাবে বাড়ছে, সেই অনুপাতে বাজেটে আয় ব্যয়ের খাতগুলো বাড়ছে কি না- সে বিষয়ে মনোযোগ বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।জিডিপির অংশ হিসেবে এই বাজেট বড়ও না, বিরাট কিছুও না। অর্থনীতিবিদ টাকার অংকে প্রচলিত টাকা দেখে না, সে প্রকৃত মূল্য বিবেচনা করে। আজকের এক টাকা যে কালকে আধা টাকা হয়ে যায় সেই কথাটা আমাদের বুঝতে হবে। দেবপ্রিয় বলেন, সরকার মোটামুটি স্বস্তির মধ্যে এবারের বাজেট দিলেও কিছু টেনশন তৈরি হয়েছে।এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে টাকার অতিমূল্যায়ন হয়েছে, যা রপ্তানি ও মূল্যস্ফতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বাজারে তেলের দামের সমঞ্জস্যবিধান হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, দাম যেটুকু কমেছে তাতে গরিবের লাভ হয়নি।বাজেটে বড় ধরনের কর প্রাক্কলন (২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা) করে রাজস্ব বাড়ানোর কথা থাকলেও তা আদায়ে বা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে কী কৌশল নেওয়া হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা দেখছেন না দেবপ্রিয়।বড় ধরনের করের প্রাক্কলন করে বড় ধরনের বিনিয়োগে অর্থায়নের চেষ্টা রয়েছে। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। এজন্য বলা হচ্ছে মোট বিনিয়োগ ৩১ শতাংশ হবে। এর আগে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কম ছিল এবার ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকে বাড়ানোটাই আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে।

একই কথা তিনি বলেছেন এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন নিয়েও।বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে মন্তব্য করে সিপিডি ফেলো বলেন, দেশে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব খুবই প্রকটভাবে এসেছে ব্যাংকিং খাতের ভেতরে।এ বাজেটের ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বিষয়টিকে এ বাজেটের অন্যতম দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেন দেবপ্রিয়।তিনি বলেন, ওই ঘাটতির ৪০ শতাংশ বিদেশি অর্থায়নে মোটানোর কথা বলা হলেও সেজন্য বড় কোনো উদ্যোগের কথা বাজেট কাঠামোতে নেই।বাংলাদেশে যেখানে কখনো বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার হয়নি, সেখানে কীভাবে রাতারাতি ৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যবহার করা হবে, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।আর ঘাটতি মেটাতে দেশীয় উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ধার করার যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যয় আরও বাড়বে বলেও মনে করছেন সিপিডির এই ফেলো।এবার উন্নয়ন ব্যায়ের চেয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় বেশি বাড়ার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, উন্নয়ন খাতেই বরাদ্দ বেশি দিতে হবে।ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাস্তবায়ন থেকে সরকারের পিছিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আগামী বছরও যাতে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করেন তিনি। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মোটামুটি স্বচ্ছ ও সুন্দর পরিবেশে এবারের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রধানত দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো সামগ্রিক অর্থনীতির চালচিত্র। আরেকটি হলো খাতওয়ারি পদক্ষেপ সমূহ।