সুমন হোসেন পাটোয়ারি ওরফে সাকিব ওরফে সিহাব ওরফে সাইফুল

গত ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনার কার্যালয়ে ঢুকে এর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুলকে নিজ হাতে কুপিয়েছিলেন সুমন হোসেন পাটোয়ারি ওরফে সাকিব ওরফে সিহাব ওরফে সাইফুল (২০)। নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) এই সদস্য চাপাতি দিয়ে টুটুলকে তিনটি কোপ দেন। বৃহস্পতিবার দুপুরের আগে মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হবে।এক মাস আগে যে ছয় সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তাদের মধ্যে প্রথম একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টার অভিযোগে।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার সুমন হোসেন পাটোয়ারি ওরফে সিহাব ওরফে সাকিব ওরফে সাইফুল নামের ২০ বছর বয়সী ওই যুবক নিষিদ্ধ জঙ্গি দল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত।বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার বিমানবন্দর থানা এলাকা থেকে সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান।তিনি বলেন, প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের স্বত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুলকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে।গত ১৯ মে এক নোটিসে সুমন ওরফে সিহাবকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের কেউ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে কি না- সে তথ্য জানা যায়নি।

মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, সুমনের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও সে বড় হয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহরে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা এই তরুণ আন্দরকিল্লায় একটি মেডিকেল ইকুইপমেন্টের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে আসছিলেন।জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, টুটুলকে সে নিজে তিনবার কোপ দিয়েছিল। ওই ঘটনায় তারা অংশ নিয়েছিল পাঁচজন; ব্যবহার করেছিল চাপাতি। পরে পাশের একটি মসজিদে ঢুকে সেই রক্তাক্ত চাপাতি ধোয়ার কথাও সুমন বলেছে।গতবছর ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে টুটুল এবং তার সঙ্গে থাকা ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করে হামলাকারীরা।সিহাবের এই ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল পুলিশের পুরস্কারের ঘোষণায়।

সিহাবের এই ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল পুলিশের পুরস্কারের ঘোষণায়।একই দিনে হামলা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে। লালমাটিয়ার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শাহবাগে জাগৃতির কার্যালয়ে এর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়।এ দুটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে লেখক অভিজিৎ রায়ের কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যিনি নিজেও গতবছর ফেব্রুয়ারিতে একইভাবে খুন হন। হামলার একদিন পর মোহাম্মদপুর থানায় টুটুলকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা করে তার পরিবার। সে সময় থেকেই পুলিশের সন্দেহ ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমকে ঘিরে।

বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল বলেন, গত ১৯ ফ্রেব্রুয়ারি বাড্ডার সাতারকুল ও মোহাম্মদপুরে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, আস্তানা দুটি আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।ওই অভিযানে গ্রেপ্তার আনসারউল্লাহর দুই সদস্যের দেওয়া তথ্যে ঢাকার আশকোনা ও দক্ষিণখানে এবং চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যেই বিমানবন্দর থানার ওভার ব্রিজ এলাকার একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে গত রাতে সুমন ওরফে শাকিব ওরফে সিহাব ওরফে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়্। সে মোহাম্মদপুরের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। আহমেদুর রশীদ টুটুল সুস্থ হয়ে চলে গেছেন দেশের বাইরেআহমেদুর রশীদ টুটুল সুস্থ হয়ে চলে গেছেন দেশের বাইরে গত ১৯ মে সুমন ওরফে সিহাবসহ আনসারুল্লাহর ছয় সদস্যকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই ছয় জঙ্গি অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান-মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যায় জড়িত। আগে গ্রেপ্তার আনসারুল্লাহ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। ওই ছয়জনের মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ এবং সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২ এর জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

আর সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, সিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল এবং সাজ্জাদ ওরফে সজিব ওরফে সিয়াম ওরফে শামসের জন্য দুই লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে ডিএমপি।অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল বলেন, যে ছয়জনের ছবি তারা প্রকাশ করেছিলেন, তাদের অনেকের বিষয়েই তারা তথ্য পেয়েছেন। কারও কারও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও পাওয়া গেছে।বাকি পাঁচ জঙ্গিকে ধরতেও অভিযান চলছে জানিয়ে উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, শিগগিরই আরও সাফল্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তারা।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম। রাজধানীর বিমানবন্দরের পদচারী–সেতুর পাশে বাসস্টেশন এলাকা থেকে গতকাল বুধবার রাত সাড়ে আটটায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সুমনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবির কাছে এসব তথ্য সুমন দেন বলে পুলিশের দাবি।গত ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে প্রকাশক আহমেদ রশিদ টুটুল ও আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনার কার্যালয়ে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দীপন মারা যান এবং টুটুলসহ তিনজন গুরুতর আহত হন। এরপর এসব ঘটনায় মোহাম্মদপুর ও শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। ডিবি ঘটনা দুটির তদন্ত শুরু করে। এর পাশাপাশি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়সহ ১০ জন লেখক, ব্লগার ও ভিন্নমতাবলম্বী খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গত ১৯ মে সুমনসহ এবিটির ছয় সদস্যের নাম ও ছবি ঢাকা মহানগর পুলিশের অফিশিয়াল সাইটে প্রকাশ করেছিল ডিবি। এতে তথ্যদাতাদের জন্য দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সুমন ছাড়াও বাকি পাঁচজন শরিফ, সেলিম, সিফাত, রাজু ও সাজ্জাদ নামে পরিচিত।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি উত্তর বাড্ডার সাতারকুল এলাকার এবিটির একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অভিযান চালায় ডিবি। এ সময় এবিটির সঙ্গে সংঘর্ষে ডিবির এক সদস্য গুরুতর আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে এবিটির দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় এবিটির একটি বোমা তৈরির কারখানা এবং দক্ষিণখানের সরদারপাড়ার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে এবিটির আরও পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৩ জুন চট্টগ্রাম থেকে এবিটির আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবিটির এসব সদস্যের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুমনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার সার্বিক সমন্বয়কারী ছিলেন শরিফ ও দীপন হত্যার মিশনে দায়িত্বে ছিলেন সেলিম। এসব তথ্য জানিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে সুমনসহ পাঁচজন জঙ্গি অংশ নেয়। এদের সবার হাতে চাপাতি ছিল। গ্রেপ্তারের পর সুমন স্বীকার করেন, তিনি টুটুলকে চাপাতি দিয়ে তিনবার আঘাত করেন। এ ছাড়া সে মোহাম্মদপুরে এবিটির বোমা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। সুমন চট্টগ্রাম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে তিনি এবিটিতে যোগ দেন। প্রথমে চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। পরে বড় কাজের জন্য ঢাকায় আসেন সুমন। মহাখালীর একটি বাসা ভাড়া করে সুমন ও আরও কয়েকজনকে চাপাতি ও ছোট অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন শরিফ।এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে সুমনের কাছ থেকে আরও তথ্য জানতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হবে।