বন্দুক যুদ্ধে নিহত শরীফ অভিজিতসহ ৬ ব্লগার হত্যার মূল হোতা

আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যার যত ঘটনা ঘটিয়েছে তার প্রত্যেকটির সঙ্গে শরীফ ওরফে সাকিব কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে দাবি করছে পুলিশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, গত ফেব্র“য়ারিতে লেখক অভিজিৎ হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সী এই যুবক।রাজধানীর খিলগাঁওয়ে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরীফ লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়াও আরো ৬ ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্ট হত্যাকান্ডের তিনিই মূল পরিকল্পনাকারী ছিল বলে জানিয়েছেন পুলিশ। রোববার বেলা ১২টায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন।এর আগে শনিবার (জুন ১৮) দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজধানীর খিলাগাঁও মেরাদিয়ার বাঁশপট্টি এলাকায় ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির নিহত হয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর তার চেহারার সঙ্গে ডিএমপির চিহ্নিত জঙ্গি শরীফের চেহারার মিল পেয়ে পুলিশ তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।এর আগে চিহ্নিত জঙ্গি শরীফ সম্পর্কে তথ্য দাতাকে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল পুলিশ।

সংবাদ সম্মেলনে আবদুল বাতেন বলেন, অভিজিৎ হত্যাকান্ডের সময় শরীফ ঘটনাস্থলে ছিল। ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজে তার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেছে। এছাড়াও তিনি ব্লগার নিলাদ্রী নিলয়, সান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদ মোর্শেদ বাবু, ফয়সাল আরেফিন দীপন, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সূত্রাপুরের নাজিমুদ্দিন সামাদ, কলাবাগানের জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। যারা তাদের হত্যা করেছে শরীফ তাদের রিক্রুট করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তিনি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে।বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে আবদুল বাতেন বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল মেরাদিয়ায় শরীফ তার সহযোগীদের সঙ্গে থাকতে পারে। তাই শনিবার রাত থেকে ডেমরা-মেরাদিয়া সড়কে অবস্থান নেয় ডিবি। রাত ২টায় সড়কটি দিয়ে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী যাওয়ার সময় পুলিশ থামার জন্য সিগন্যাল দেয়।

তবে মোটরসাইকেলটি না থেমে পুলিশের উপর গুলি চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলে একজন মারা যায়। মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে রোববার সকালে পুলিশ শরীফের চেহারা শনাক্ত করেন। এধরনের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় মূল আসামিরা মারা গেলে তদন্তে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে কিনা- সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল বাতেন বলেন, পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। তারা থাকলে তদন্ত সুবিধা হতো। তবে আমার মনে হয় না এতে কোনো সমস্যা হবে। কারণ অন্যান্য জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দীর ভিত্তিতে তদন্ত চলে।এদিকে বন্দুকযুদ্ধের সময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি মোটরসাইকেল, ১টি বিদেশি পিস্তল ও ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।এর আগে মে মাসে ৬ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে ডিএমপি। এতে বিষয়ে তথ্য দিতে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ৬ জনের মধ্যে শরীফের নাম প্রথমে ছিল।

শনিবার রাত ২টার দিকে ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে শরিফুল নিহত হন।পুলিশ বলছে, সাকিব, শরিফ, সালেহ, আরিফ ও হাদী নাম ব্যবহার করে পরিচয় গোপন করে আসছিলেন শরিফুল। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, লেখক-ব্লগার হত্যার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটি শরীফ জানত।শরিফ ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল, প্রকাশক টুটুল হত্যাচেষ্টার দিন লালমাটিয়ায় বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিল এবং ওয়াশিকুর বাবু হত্যা, আশুলিয়ায় রিয়াজ মোর্শেদ বাবু হত্যারও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিল, বলেন তিনি। গতবছর লব্র“য়ারিতে অভিজিত খুন হওয়ার পর একে একে খুন হয়েছেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ।

এর আগে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর কয়েক দিনের মাথায় খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ‘অপারেশন বিভাগ’ এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন শরীফ, যে বিভাগ প্রত্যেক হত্যার পরিকল্পনা থেকে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সাতারকুলসহ বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে সংগঠনটির বিভিন্ন নথিপত্র পান তারা। বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তার আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ’ বিভিন্ন তথ্যও।এাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, একজন আধ্যাত্মিক নেতা (বুজুর্গ বলে তারা) সংগঠনটির নেতৃত্বে থাকেন। তিনি সংগঠনের পক্ষে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। তার পরে থাকে সংগঠনটির একজন অপারেশনাল প্রধান। তিনি সব হত্যার পরিকল্পনা করেন ও নির্দেশনা দেন ও সার্বিক মনিটরিং করেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে কর্মীদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন শরীফ। তিনি বিভিন্ন হত্যার অভিযান সমন্বয়ও করতেন। হত্যা যেখানে করা হতো ওই এলাকায় অবস্থানও করতেন শরিফ।

সেলিম নামে আনসারুল্লাহর উচ্চপর্যায়ের এক সদস্য রয়েছেন জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাশরুকুর বলেন, কাকে হত্যা করতে হবে, কেন হত্যা করতে হবে, কোন এলাকায় কীভাবে গিয়ে হত্যা করতে হবে- তার তথ্য সংগ্রহ করে নির্দেশনা দেন সেলিম।এছাড়া যারা হত্যায় অংশ নেবেন তাদের মোটিভেশনাল ট্রেইনিং দেন। নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন ওই লোককে হত্যা করা জরুরি- তাও সেলিম ব্যাখ্যা করেন। হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে শরীফ ও সেলিম তাদের একজন অপারেশনাল প্রধান (বড় ভাই) এর সঙ্গে বৈঠক করতেন। এজন্য তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের ভাড়া বাসায় বসতেন।রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এই রকম বেশ কিছু ভাড়া বাসার তথ্য গোয়েন্দারা সংগ্রহ করেছেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, অপারেশনাল প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে হত্যায় সংগঠনের লক্ষ্য কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটিও তুলে ধরতেন সেলিম ও শরীফ। এরপর যাকে হত্যা করতে হবে তার গতিবিধির উপর নজরদারি বাড়াতেন। তার বাসা ও কর্মস্থলের এলাকা তারা সাত দিন আগে রেকি করতেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র শরীফের বাড়ি খুলনা এলাকায়। তিনি একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরি করতেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল।

ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন যে ছয় জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ মাসখানেক আগে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তাদের মধ্যে শরিফুল দ্বিতীয় জন, যার সন্ধান পাওয়ার খবর দিল পুলিশ।এর আগে গত ১৫ জুন একই দলের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারি ওরফে সিহাব ওরফে সাকিব ওরফে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মাশরুকুর বলেন, সুমন পাটোয়ারি জিজ্ঞাসাবাদে শরীফের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিলে গোয়েন্দারা রাতে মেরাদিয়ায় অভিযান চালায়। এসময় একটি মোটরসাইকেলে থাকা তিন যুবক পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে শরীফ আহত হন এবং বাকি দুই জন তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। মেরাদিয়াতে ওই মোটরসাইকেলে সেলিম ছিল না। পুলিশের কাছে তার শারীরিক বর্ণনা আছে; সে দেখতে লম্বা ও মোটাসোটা। কিন্তু যেই দুইজন মোটরসাইকেলে ছিল তারা মাঝারি আকৃতির যুবক। সেলিমকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দা। অনেককে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, অন্য যারা এই দলে রয়েছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।