হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবেকদর সন্ধান করো। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম,  নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবেকদর সন্ধান করো। -সহিহ বোখারি

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে দণ্ডায়মান হয়, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

যে রাতটি লাইলাতুল ক্দর হবে সেটি বুঝার কিছু আলামত সে রাতের কিছু আলামত হাদিসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হলো-

এক. এ রাতটি রমজান মাসে। আর এ রাতের ফজিলত কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।

দুই. এ রাতটি রমজানের শেষ দশকে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। -সহিহ বোখারি

তিন. আর এটি রমজানের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ কর। -সহিহ বোখারি

চার. এ রাত রমজানের শেষ সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রমজানের শেষ সাত রাতের মধ্য তা অন্বেষণ করে।’

পাঁচ. রমজানের ২৭ শে রজনী লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

ক. হাদিসে আছে, উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল (সা.) আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমজানের ২৭ তম রাত। -সহিহ মুসলিম

খ. হজরত আবদুল্লাহ বিন উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমজানের ২৭ রজনীতে অনুসন্ধান করে। -আহমাদ

গ. কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল ২৫ তারিখ, তৃতীয় হল ২৯ তারিখে। চতুর্থ হল ২১ তারিখ। পঞ্চম হল ২৩ তারিখের রজনী।

ছয়. সর্বশেষ আরেকটি মত হলো- মহিমান্বিত এ রজনীটি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধুমাত্র ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হিকমত ও তার ইচ্ছায় কোনো বছর তা ২৫ তারিখে, কোনো বছর ২৩ তারিখে, কোনো বছর ২১ তারিখে, আবার কোনো বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে।

সাত. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।

আট. নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।

নয়. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।

দশ. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।

এগারো. কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।

বারো. ওই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।

তেরো. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত। -সহিহ ইবনু খুজাইমা: ২১৯০; বোখারি: ২০২১; মুসলিম: ৭৬২

শবেকদর রহস্যাবৃত থাকার কারণ

আল্লাহতায়ালা গোটা বছরের প্রত্যেক রাতের মধ্যে যে একটি রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সেটি হলো, ‘লাইলাতুল কদর’ বা মর্যাদার রাত। আল্লাহতায়ালার ভাষায়, ‘নিশ্চয় আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি বরকতময় ‎রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।‎ ‎সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ‎অনুমোদিত হয়।’ আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল ‎কদরে। ‎তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ‎সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের ‎রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ ‎করে।‎ শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে।’ -সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ৭৬০; সহিহ বোখারি: হাদিস নং ২০১৪

তাই এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রমজান মাসের আগমন ঘটলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। একমাত্র (সর্বহারা) দুর্ভাগাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।’ -সুনানে ইবনে মাজা: হাদিস নং ১৬৪৪

তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে এ রাতের খায়ের-বরকত লাভে সচেষ্ট থাকা।

একটি মাসয়ালা: অনেকের মনে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, সাতাশের রাতই হচ্ছে শবে কদর। এই ধারণা সঠিক নয়। সহিহ হাদিসে এসেছে যে, রাসূলে কারিম (সা.) কে লাইলাতুল কদর কোন রাত তা জানানো হয়েছিল। তিনি তা সাহাবিদেরকে জানানোর জন্য আসছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে সেখানে দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। তাদের ওই ঝগড়ার কারণে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে সে রাতের ইলম উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ কথাগুলো সাহাবিদেরকে জানানোর পর নবী করিম (সা.) বললেন, হতে পারে, এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। এখন তোমরা এ রাত (অর্থাৎ তার বরকত ও ফজিলত) রমজানের শেষ দশকে অন্বেষণ কর। -সহিহ বোখারি: হাদিস নং ২০২০, সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৫/২০৯

অন্য হাদিসে বিশেষভাবে বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর তালাশ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। -সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৫, তাই সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।

শবেকদরের আলামত
আল্লাহতায়ালা বলেন, যির ইবনে হুবাইশ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি উবাই ইবনে কাবকে বলতে শুনেছি, তাকে বলা হয়েছিল, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রাত জাগ্রত থাকবে, সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে। উবাই বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, সন্দেহ নেই লাইলাতুল কদর রমজানে। তিনি নির্দিষ্টভাবে কসম করে বলেন, আল্লাহর শপথ আমি জানি তা কোন রাত, এটা সে রাত, যার কিয়ামের নির্দেশ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রদান করেছেন, তা হচ্ছে সাতাশের সকালের রাত, তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না।’ -সহিহ মুসলিম

ইবনে হিব্বানের এক বর্ণনায় আছে, ‘তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না, যেন তার আলো মুছে দেয়া হয়েছে।’

ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের শেষ সাতের মাঝখানে, সেদিন সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবে, তার মধ্যে কোনো কিরণ থাকবে না। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন।’ -মুসনাদে আহমদ

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা হচ্ছে সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত, সে রাতে কঙ্করের চেয়ে অধিক সংখ্যায় ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবস্থান করেন।’ -মুসনাদে আহমদ

শবেকদরের দোয়া
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বলেছি, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমি যদি লাইলাতুল কদর জানতে পারি, আমি তাতে কি বলব? তিনি বললেন, তুমি বলবে, (উচ্চারণ) ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন কারিম তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি।’

অর্থ: ‘হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, মহানদাতা-সম্মানিত, ক্ষমা করা ভালোবাস, অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর।’ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এ হাদিস হাসান, সহিহ।

শবেকদর রহস্যাবৃত থাকার রহস্য

শবেকদর রহস্যাবৃত থাকা সম্পর্কে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো-

ক. শবেকদর নির্দিষ্ট করা হলে অনেক গাফেল (অলস) লোক অন্যান্য রাতে ইবাদত করাই ছেড়ে দেবে।

খ. অনেক লোক রয়েছে যারা পাপকর্ম ছাড়া থাকতে পারে না- তারিখ নির্ধারিত থাকলে যদি জেনে-শুনে কোনো ব্যক্তি পাপকর্মে লিপ্ত হতো, তবে সেটা তার জন্য অধিক বিপজ্জনক হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। একবার নবী করিম (সা.) দেখলেন, এক সাহাবি মসজিদে ঘুমাচ্ছেন। তিনি হজরত আলীকে বললেন, আলী যেন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগিয়ে অজু করতে বলেন। হজরত আলী এ নির্দেশ পালন করার পর হুজুর (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো সকল পুণ্য কাজেই অগ্রগামী, এ ব্যাপারে আপনি নিজে তাকে না বলে আমাকে দিয়ে জাগানো ও বলানোর তাৎপর্য আছে কি? হুজুর (সা.) বললেন, আমার ভয়, ঘুমের ঘোরে পাছে সে ব্যক্তি গাত্রোত্থান করতে অসম্মত হয় আর নবীর কথা অমান্য করায় কুফরিতে নিপতিত হয়ে পড়ে। তোমার কথায় অস্বীকৃতি জানালে কুফরি হতো না।

গ. শবেকদর নির্দিষ্ট থাকলে এবং ঘটনাচক্রে কোনো ব্যক্তি ওই রাতে ইবাদত হতে বঞ্চিত হলে এ শোকে সে পরবর্তী রাতগুলোতে আর ইবাদতের জন্য জাগতে পারত না।

ঘ. শবেকদরের ইবাদত করার উদ্দেশ্যে যেসব রাতে জাগরণ করা হয়, সেসব রাতের স্বতন্ত্র নেকি পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাতের নফল নামাজে এক এক রাকাতে পূর্ণ কোরআন শরিফও খতম করে দিতেন।