জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ ও অন্যতম সহযোগী তাহমিদের সঙ্গে হলি আর্টিসানের ছাদে হাসনাতের শলাপরামর্শ (বাঁয়ে)। ব্রিফিং শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন হাসনাত। এ সময় সশস্ত্র অবস্থায় ছিল জঙ্গিরা (গোল চিহ্নিত)
জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ ও অন্যতম সহযোগী তাহমিদের সঙ্গে হলি আর্টিসানের ছাদে হাসনাতের শলাপরামর্শ (বাঁয়ে)। ব্রিফিং শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন হাসনাত। এ সময় সশস্ত্র অবস্থায় ছিল জঙ্গিরা (গোল চিহ্নিত)

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় প্রকাশিত কয়েকটি ছবিতে দুই জিম্মি হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে জঙ্গিদের সঙ্গে ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ কারণে ৫৪ ধারায় আটকের পর পুলিশ হাসনাত-তাহমিদকে ৮ দিন রিমান্ডে নিয়ে তাদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজে’র সঙ্গে কিছু তথ্য মিলিয়ে দেখছে। কী সে সব তথ্য? পুলিশ কর্মকর্তাদের নানা প্রশ্নের উত্তরে কি বলছেন ৮ দিনের রিমান্ডে থাকা হাসনাত ও তাহমিদ?

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ছবিতে হাসনাতের মুখের কাছে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা দেখে বলা হচ্ছে, হাসনাত জঙ্গিদের সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছিলেন। তিনি কি সত্যিই সিগারেট খাচ্ছিলেন? জিজ্ঞাসাবাদে হাসনাত দাবি করেছেন, তিনি ‘নন স্মোকার’। বিষয়টি তারাও যাচাই করে দেখছেন। এদিকে, তাহমিদের হাতের অস্ত্র দেখে বলা হচ্ছে তিনিও জঙ্গিদের সহযোগী; না হলে অস্ত্র হাতে থাকার পরও কেন প্রতিরোধ করলেন না জঙ্গিদের? তাহমিদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক কর্মকর্তা জানান, তাহমিদ দাবি করেছেন, অস্ত্রের মুখে জিম্মি হয়েই তিনি জঙ্গিদের কথামতো নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। বাইরের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘শো’ করানোর জন্যই অস্ত্র হাতে তাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করেছেন তাহমিদ।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলছেন, প্রাথমিক তদন্তে তাহমিদের হাতে যে অস্ত্রটি ছিল তাতে কোনও ম্যাগাজিন ছিল না বলে জানা গেছে। এমনকি ওই আগ্নেয়াস্ত্র থেকে কোনও গুলি ছোড়ার প্রমাণও পাননি তারা। তবুও অস্ত্রটিতে প্রকৃতই ম্যাগাজিন ছিল কিনা এবং গুলি ছোড়া হয়েছিল কিনা তা অধিকততর তদন্তের জন্য ব্যালাস্টিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা সন্দিগ্ধ হিসেবেই হাসনাত ও তাহমিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। রিমান্ড শেষ হলে তাদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা যেসব কথা বলছেন, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বস্তুগত কিছু তথ্য-প্রমাণও মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। সিটির কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে হাসনাত ও তাহমিদ দাবি করেছেন, জঙ্গিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি হয়েই তারা ছাদে ও বারান্দায় গিয়েছিলেন। জঙ্গিদের কথামতো কাজ না করলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলা হতো বলেও দাবি করেছেন জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছে।এদিকে, লিখিত এক বক্তব্যে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে একই দাবি করেছেন হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিন করিমও। শারমিন করিম তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘সারারাত আমাদের বন্দুকের সামনে রেখেছিল এবং আমার স্বামী হামলাকারীদের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের নির্দেশ মতো কাজ না করলে আমাদের মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।’

নানা নাটকীয়তা শেষে গুলশান হামলার ৩৩ দিনের মাথায় গত ৩ আগস্ট রাতে গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় আটক করা হয় হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে। পরদিন ৪ আগস্ট তাদের আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেকের ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সোমবার তাদের রিমান্ডের পঞ্চম দিন অতিবাহিত হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটির একজন কর্মকর্তা জানান, তারা হাসনাত করিম ও তাহমিদের দেওয়া বক্তব্যগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিশেষ করে জিম্মি ঘটনায় উদ্ধার হওয়া ৩২ জনের সঙ্গেই তারা কথা বলেছেন। এদের মধ্যে ২০ জনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নথিভুক্ত করেছে পুলিশ। এছাড়া ৯ জন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তির মধ্যে ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশের সাক্ষ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, দু-একদিনের মধ্যে তাহমিদের দুই বান্ধবী ফাইরাজ ও তানহারও জবানবন্দিও নেওয়া হবে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ওই কর্মকর্তা বলেন, অন্যদের বক্তব্যের সঙ্গে হাসনাত ও তাহমিদের বক্তব্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হাসনাত ও তাহমিদ জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলেছেন ও ছাদে বা বারান্দায় গিয়েছিলেন, তা বলতে পারবেন অন্য জিম্মিরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হাসনাত করিম ও তার স্ত্রী শারমীন করিম দাবি করে আসছিলেন যে, তাদের মেয়ের ১৩তম জন্মদিন পালন করতেই তারা হলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়েছিলেন। সে দিন হাসনাতের মেয়ের জন্মদিন ছিল, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে সেদিন জন্মদিন উদযাপনের জন্য তারা সেখানে গিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রথম দিকেই মারা যান পুলিশের দুই কর্মকর্তা এসি রবিউল করিম ও পরিদর্শক সালাউদ্দিন আহমেদ খান। আর জঙ্গিদের হাতে মারা যান দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হলি আর্টিজানের এক কর্মচারী। আর সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে মারা যান ছয় জঙ্গি; যাদের মধ্যে একজনকে পরিবারের সদস্যরা হলি আর্টিজানের শেফ বলে দাবি করেছেন।

বাংলা ট্রিবিউন