14-10-16-bd-pm_china-president_delegation-meeting-1

জঙ্গিবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য,অবকাঠামো,সমুদ্র সহযোগিতা, কর্ণফুলি টানেল নির্মাণসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন।শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সফররত চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়।পরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ১৫টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়েছে সরকার টু সরকার পর্যায়ে। যার ১২টি লোন এগ্রিমেন্ট ও মিউচুয়াল এগ্রিমেন্ট। মোট সাতাশটি। ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন। কী কী বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক হয়েছে জানতে চাইলে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, মেরিটাইম খাতে সই হয়েছে।তিনি বলেন, ইকোনোমিক ও টেকনিক্যাল কো-অপারেশন ও একটা ফ্রেইম ওর্য়াক হয়েছে রোড অ্যান্ড টানেলের ব্যাপারে। সুয়ারেস টার্মিনাল ব্যাপারে একটা এগ্রিমেন্ট হয়েছে।শুক্রবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।এর আগে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন এবং দুই দেশের প্রতিনিধিদল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে তাদের মধ্েয ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।শি জিনপিং বলেন, আমরা চীন বাংলাদেশ সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের জায়গা থেকে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি।চীনের প্রেসিডেন্ট বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শিমুল কক্ষে একান্ত বৈঠকে অংশ নেন দুই নেতা।পরে চামেলি কক্ষে দুই দেশের প্রতিনিধিরা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর হয় চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। দুই নেতা ছয়টি প্রকল্পের ফলকও উন্মোচন করেন।তবে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর শিরোনাম ও ঋণচুক্তির অর্থের পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে শি জিনপিংয়ের এই ঢাকা সফর। ১৯৮৬ সালে লি শিয়ানইয়ানের পর বাংলাদেশে আসা প্রথম চীনা রাষ্ট্রপ্রধান তিনি।বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এ সফরকে সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনাবলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আর সকালে ঢাকা পৌঁছানোর পর এক বিবৃতিতে শি জিনপিং বলেছেন, তার দেশ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চেলের ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’ বলে মনে করে।পারস্পরিক রাজনৈতিক আস্থার সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমরা প্রস্তুত। দুই দেশের সহযোগিতার সম্পর্ককে আমরা আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে চাই, বলেন শি।জঙ্গিবাদ বিষয়ে একটা চুক্তি সই হয়েছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের বিষয়ে দুই দেশ এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সম্মত। এক মত হয়েছেন দুই নেতা। বিশেষ করে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, তথ্য বিনিময়, একচেঞ্জ অব গুড প্র্যাকটিজ এবং একটা সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই দেশের মধ্যে।পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ ও চায়নার রিলেশনটা বিশেষ করে ট্রেড ও ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে একটা লম্বা ইতিহাসের। নতুন কিছু ক্ষেত্রও এখানে আবিষ্কার হয়েছে। বিশেষ করে আইসিটি ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।আইসিটি খাতে একটা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হবে বলে জানান শহীদুল হক।তিনি বলেন, একই সঙ্গে ট্রাডিশনাল যে খাতগুলো ছিল- কৃষি, বাণিজ্য ও অন্যান্য খাত, সেগুলোতেও আরও গভীর ও সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।চীনের ব্যবসায়ীরা আরএমজি ও পাট সেক্টরে বিশেষ বিনিয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানান সচিব।শহীদুল হক বলেন, প্রোডাকশন ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট হয়েছে। এই কাঠামোগত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে যে উৎপাদন ক্ষমতা, সেটি বাড়ানোর জন্য চাইনিজরা প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন এনটিটি গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।শি জিনপিংয়ের এই সফরের মধ্য দিয়ে চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ উন্নীত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সচিব জানান, সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের সরকারের মধ্েয ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে।তবে ঋণ চুক্তির আর্থিক পরিমাণ ও বিস্তারিত জানতে কয়েক দিন সময় লাগবে বলে জানান তিনি।সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সফল হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, চীনের রাষ্ট্রপতির সফর ঐতিহাসিক, দুই দেশের মধ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিকতা আরও বিস্তৃত ও গভীর হবে, ব্যাপ্তি বাড়বে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ট ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এখন কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আমরা সম্পর্কের নতুন অবয়ব দেখব।১৯৮৬ সালে লি শিয়ানইয়ানের পর বাংলাদেশে আসা প্রথম চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং। ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে তার এই ঢাকা সফর।বৈঠকে উঠে আসা বিষয়গুলোর রাজনৈতিক দিক রয়েছে মন্তব্য করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আগামীতে বিভিন্ন পর্যায়ে দুই দেশের সফর দেখা যাবে। ট্রড ও ইনভেসমেন্টে নতুন ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। আইসিটিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে।শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ও পাটে বিনিয়োগের ইংগিত দিয়েছে চীন। উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে।বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যে উন্নয়ন করেছে সেখান থেকে চীনের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।

দুই নেতা জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করতেও একমত হয়েছেন বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান।তিনি বলেন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও তথ্য আদান-প্রদানে এমওইউ হয়েছে।চীনের ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্েযাগ বাস্তবায়নে একসঙ্গে এগোনোর পাশাপাশি নৌ যোগাযোগ ও সন্ত্রাসদমনের মতো বিষয়গুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বিষয়েও দুই দেশের মতৈক্য হয়েছে।ঢাকা সফররত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যুক্ত বিবৃতিতে এই মতৈক্যের ঘোষণা আসে।বিবৃতিতে বলা হয়, এই সহযোগিতা হবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও।শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই বৈঠকের পর দুই নেতার উপস্থিতিতে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হয়, ছয়টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন তারা।এর মধ্য দিয়ে সহযোগিতার একটি উচ্চতর ভিত্তি তৈরি হল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, অবকাঠামো, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সহযোগিতা জোরদারে আমরা ঐক্যমতে পৌঁছেছি।শি জিনপিং বলেন,আমরা চীন, বাংলাদেশ সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ সর্বাত্মক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্র থেকে কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতায় উন্নীত করতে একমত হয়েছি। এছাড়া উচ্চ পর্যায়ের মত বিনিময় এবং কৌশলগত যোগাযোগে সম্মত হয়েছি, যাতে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি উচ্চতর পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হয়।বাংলাদেশকে চীনের ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু ও ভালো অংশীদার’ অভিহিত করেন তিনি।তিন দশক পর চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে সকালে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসেন শি জিনপিং। তার এই সফরকে ঐতিহাসিক বলেছে দুই দেশই।শি বলেন, চীন, বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন একটি নতুন ঐতিহাসিক সূচনা বিন্দুতে এবং একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল এবং একে অন্যকে সমর্থন করে এমন বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে এগিয়ে যেতেবাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত চীন। এবং কৌশলগত সহযোগিতায় নতুনত্ব আনতেও চীন প্রস্তুত।এই প্রক্রিয়ায় চীন বাংলাদেশ সহযোগিতা জনগণের জন্য আরও সুফল বয়ে আনবে এবং এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট শি।আমাদের উন্নয়ন কৌশলসমূহের মধ্যে সঙ্গতি তৈরি, যৌথভাবে ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোডউদ্েযাগ নিয়ে এগোনো, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদারে চীন বাংলাদেশ এফটিএ সম্ভাব্যতা যাচাই এবং অবকাঠামো, উৎপাদন সক্ষমতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন, আইসিটি ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সহযোগিতা জোরদারে আমরা সম্মত হয়েছি। শি জিনপিং বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।রাষ্ট্রীয় এই অতিথিকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। লাল গালিচা সংবর্ধনার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল তাকে গার্ড অফ অনার দেয়।১৩ সদস্েযর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকা এসেছেন শি, যে দলে ক্ষমতানীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ছাড়াও কয়েকজন মন্ত্রী রয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হোটেলে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন দুই রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ ও শি জিনপিং। সফররত প্রেসিডেন্টের সম্মানে নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।শনিবার সকালে সাভারে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। এর পরপরই ঢাকা ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি।