বাংলাদেশের রিজার্ভের টাকা চুরি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি হওয়া অংশের বাকি সাড়ে ছয় কোটি ডলার উদ্ধারে এখন ফিলিপাইনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। দলটি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করবে বলে জানা গেছে। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়ে গেছে। দেশটির আইনমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সিনেটের চেয়ারম্যান, গভর্নরের সঙ্গে অবশ্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের মুখপাত্র আর্নেস্তো অ্যাবেলা সোমবার বৈঠক বাতিলের তথ্য জানান। তিনি বলেন, বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ওপর তাৎক্ষণিকভাবেই মনোযোগ দেওয়ার চাপ থাকতে পারে বলে তা বাতিল করা হয়েছে।এদিকে ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ ফিলিপাইনের দৈনিক ইনকোয়ারার-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নিশ্চয়ই আমরা রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন কাছে অর্থ দাবি করব। সিনেটের কিছু সভায় তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিল, দোষ প্রমাণ হলে বাংলাদেশকে পাঁচ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি হওয়া অংশের দেড় কোটি ডলার নগদ ফেরত দিয়েছে ফিলিপাইন। তবে বাকি ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার উদ্ধারে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ফিলিপাইন পাঠিয়েছে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ফিলিপাইন সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে।আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে আছেন অর্থ মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান।জানা গেছে, রিজার্ভের চুরি হওয়া অংশের আরও ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার (৩৭১ কোটি টাকা) উদ্ধারের আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অর্থ ফিলিপাইনের কয়েকটি ক্যাসিনো থেকে জব্দ করা হয়েছিল, যা নিয়ে বর্তমানে দেশটিতে মামলা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানও সম্প্রতি এসব কথা জানিয়েছেন। মূলত এ অর্থ আদায়ের লক্ষ্যেই উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলটি ফিলিপাইনে রয়েছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (নিউইয়র্ক ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় ও বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে যায়। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত পাওয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি হওয়া অংশের ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার ফিলিপাইন থেকে ফেরত পাওয়ায় বাকি থাকল আরও ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।

এদিকে,বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আটকে রেখেছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।মঙ্গলবার সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধির কাছে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়।আমরা ফরাসউদ্দিন সাহেবের প্রতিবেদন দেখতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ওই প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর কাছে রয়েছে, তিনি প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না’, বলেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি শওকত আলী।এই জবাব পেয়ে সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদনটি জোগাড় করে পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিনিধিকে বলেছেন।শওকত আলী বলেন, অর্থমন্ত্রী দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কিন্তু সংসদ এবং সংসদীয় কমিটিকে তো এটা (প্রতিবেদন) দেখাতে হবে।গত ফেব্র“য়ারিতে সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রাখা বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়।এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার।

শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থের বেশিরভাগটাই স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে। তার কিছু অংশ উদ্ধারের পর সম্প্রতি বাংলাদেশ ফেরত পেয়েছে।বিশ্বজুড়ে আলোচিত এই ঘটনায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল।মার্চ মাসে সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি, যার প্রধান করা হয় সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে।ফরাসউদ্দিন গত ৩০ মে ওই প্রতিবেদন দেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, রিপোর্টে যা আছে, তা অবশ্যই প্রকাশ করা হবে।

এরপর কয়েক দফা সময় দিয়েও কথা রাখেননি মুহিত। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেও তিনি পরে তার অবস্থান থেকে সরে যান।এর আগে প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারপরে সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটিও ওই প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চেয়েছিল।সংসদীয় কমিটির বৈঠক নিয়ে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মোট খোয়া গেছে ৮১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। বাকি ৬৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩৪ মিলিয়ন পাইপলাইনে আছে। আর বাকি ৩২ মিলিয়ন ডলারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।কমিটি ওই ৩২ মিলিয়ন ডলার চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বলেও জানান তিনি।শওকত আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া, আবদুর রউফ এবং নাভানা আক্তার অংশ নেন।