হাতে রশি বেঁধে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে করতে টেনে-হিজড়ে ও রাজাকাররা আমাকে নিয়ে যায় ফেনীর দাগনভূঞার রাজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কক্ষে। সেখানে আঘাত আর নির্যাতনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি, অসহ্য যন্ত্রণায় মাঠিতে শুয়ে, তাদের টানা হিজড়ায় পরনের কাপড় ছিড়ে গেল, বাঁচার জন্য অনেক আকুতি করেছি কিন্তু না থেমে নেই নির্যাতন। উলঙ্গ দেহে বেড়ে গেল বর্বর নির্যাতনের মাত্রা। সে নির্যাতন ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর ব্যথা নিয়ে আজো বেঁচে থাকা পল্লী চিকিৎসক হালিম।

সেই রাত ছিল ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর রাত ২টা আমাকে ও আশরাফকে গুলি মেরে লাশ পানিতে ফেলার উদেশ্যে নেয়া হচ্ছিল ফেনী নদীর পোলের উপর। কিন্তু আমাদের শরীরের ভর নিতে না পেরে নিকটের রাজাপুর চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে ফেনা যুক্ত পুকুর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পিঠে বাঁশ বেঁধে দাড় করিয়ে পর পর গুলি করা হয়। রাইফেলের গুলিটা আমার পিঠের মেরুদন্ডে লাগে, আর আশরাফের বুকে লাগে। মহুর্তের মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাদের ফেলে দেয়া হয় পুকুরে। রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিল পুকুরের পানি। দু-জনেই কাঁতরাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে রাজাকার আলবদররা চলে গেল তাদের টচার সেল নামক রাজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে।

আশরাফ আমার সামনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো আর আমি নিথর উলঙ্গ দেহটা নিয়ে কাঁতরাতে কাঁতরাতে পূর্ব-জয়নারায়নপুর গ্রামের আব্বাস ভূঞা বাড়িতে উঠি। সেখানে আমাদের আরেক মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজামান খোকনদের ঘরের দরজা নক করতেই বের হন তার বাবা আবদুল ওহাব কাকা। রক্তাক্ত আর উলঙ্গ দেহটা দেখে উনি লুঙ্গি আর গামছা দিলেন লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার জন্য। তখন ফজরের আজান দিচ্ছেলেন মুয়াজ্জিন। ওহাব কাকা ও কাদের কাকা আমাকে জায়লস্কর নিয়ে চিকিৎসা দিলেন। দীর্ঘ ২ মাস চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হই। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর ব্যাথা নিয়ে আজো বেঁচে আছেন পল্লী চিকিৎসক হালিম আমাবশ্যা-পূর্ণিমায় রাতে যন্ত্রণায় কাঁদি।